সুস্থ থাকতে শরীরচর্চার পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসের দিকেও আমাদের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। আর তার জন্য শরীরে প্রয়োজন নানা ধরনের ভিটামিন ও পুষ্টি। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ও পুষ্টির চাহিদা বজায় রাখার জন্য নানান রকমের শাকসবজি, ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। তেমনই একটি সবজি হল গাজর, যা পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এই সবজিটি রয়েছে উচ্চমানের ভিটামিন, খনিজ, বিটা ক্যারোটিন এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা রান্নার পাশাপাশি ত্বক ও স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকার। তাই আজকের নিবন্ধে ত্বক ও স্বাস্থ্যের পক্ষে আশ্চর্যজনক কয়েকটি গাজরের উপকারিতা কথা বলব যা সকলের জেনে রাখা উচিত।
পুষ্টিগুণে ভরপুর গাজর ভিন্ন ধরনের রান্নার রেসিপিতে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া শীতের কনকনে ঠাণ্ডায় গাজরের হালুয়া বা গাজরের পায়েস খাওয়ার মজাই আলাদা।
আরও পড়ুন । ত্বকের সৌন্দর্য বজায় রাখতে টমেটোর উপকারিতা
আরও পড়ুন । ত্বক, চুল ও স্বাস্থ্যের জন্য পেঁয়াজের উপকারিতা
গাজর (carrots)
গাজর একটি পুষ্টিকর সবজি। শীতকালে এই সবজিটির চাহিদা প্রচুর। গাজরকে যে কোনও উপায়ে শাকসবজি, সালাদ, রস বা স্যুপের সাথে নিজেদের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই সবজিটির অনেক গুনাগুণ রয়েছে। আয়ুর্বেদে গাজরকে বহু সংশ্লেষের ওষুধ বলা হয়।
আরও পড়ুন । অ্যাভোকাডো : স্বাস্থ্যের জন্য অ্যাভোকাডোর উপকারিতা
গাজরের পুষ্টিগুণ (Nutritional value of carrots)
- ক্যালোরি 41
- জল- 88%
- চিনি- 4.5 গ্রাম
- প্রোটিন – 0.9 গ্রাম
- ফ্যাট- 0.2 গ্রাম
- কার্বস- 9.6 গ্রাম
- ফাইবার- 2.8 গ্রাম
আরও পড়ুন । স্বাস্থ্যের জন্য আনারসের উপকারিতা
গাজরের পুষ্টিগুণের উপকারিতা (Nutritional benefits of carrots)
- ক্যালোরি – আমাদের দেহে শক্তি জোগান দেয়।
- প্রোটিন –শরীরের ত্বক, চুল, নখ, হাড় বিকাশে প্রোটিন প্রয়োজন।
- কার্বস – কার্বোহাইড্রেটগুলি আমাদের দেহে গ্লুকোজ হিসাবে দ্রুত রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে।
- ফাইবার – হজম স্বাস্থ্য এবং নিয়মিত অন্ত্রের জন্য ফাইবার প্রয়োজনীয়।
আরও পড়ুন । কিসমিসের উপকারিতা: শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত কিসমিস
গাজরের উপকারিতা ও ব্যবহার (Benefits and uses of carrots)
-
স্বাস্থ্যের উপকারিতা (Health benefits)
- দৃষ্টি শক্তি বাড়ায় (Increases eyesight)
চোখের দৃষ্টি বৃদ্ধিতে গাজরের উপকারিতা অতুলনীয়। এতে উপস্থিত বিটা ক্যারোটিন যা লিভারে ভিটামিন – এ তে রূপান্তরিত হয়। এই ভিটামিন রেটিনাকে রেডোপসিনে রূপান্তরিত করে, যা রাতের দৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় একটি রক্তবর্ণ রঞ্জক পদার্থ। এটি চোখের সমস্যা সমাধান করে এবং চোখের দৃষ্টি শক্তি বাড়িয়ে তোলে।
অনেকসময় বয়স বৃদ্ধির কারণে চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ কমে যেতে থাকে। বয়সজনিত চোখের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে গাজরে থাকা বিটা-ক্যারোটিন খুবই উপকারী।
আরও পড়ুন । চুল পাকার কারণ এবং চুল পাকা থেকে মুক্তির উপায়
2. ক্যান্সার প্রতিরোধ (Cancer prevention)
গবেষণায় দেখা গেছে, যে গাজর ফুসফুসের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। গাজরগুলি এন্টি-কার্সিনোজেনিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে যা কোলন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়।
আরও পড়ুন । রইল ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য স্বাস্থ্য টিপস
3. এন্টি-এজিং উপকারিতা (Anti-aging benefits)
গবেষণায় বলা হয়েছে যে, সূর্যের ক্ষতিকারক ইউভি রশ্মি মুখের বার্ধক্যজনিত লক্ষণগুলির প্রধান কারণ হিসাবে প্রমাণিত। বার্ধক্যজনিত এই লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে শুষ্ক ত্বক, বলিরেখা, পিগমেন্টেশন এর মতো সমস্যা।
গাজর ভিটামিন সি সমৃদ্ধ যা দেহের কোলোজন উৎপাদনে সহায়তা করে। কোলোজন এক ধরণের প্রোটিন যা ত্বকের নমনীয়তা বজায় রাখার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এটা জেনে অবাক হবেন যে গাজরে উপস্থিত বিটা-ক্যারোটিন একটি কার্যকর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ত্বককে ফ্রি র্যাডিক্যাল এবং সূর্যের ইউভি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে এবং ত্বককে তরুণ রাখতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন । কালোজিরার উপকারিতাঃ কালোজিরার আশ্চর্যজনক উপকারিতা
4. হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক (Helps to increase digestion)
গাজরগুলি ফাইবারের ভালো উৎস। যা হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
আরও পড়ুন । স্বাস্থ্যের পক্ষে অ্যালোভেরার উপকারিতা
5. হাড় মজবুত রাখে (Keeps bones strong)
অনেকসময় দেখা যায় বয়সজনিত কারণে আমাদের হাড়ের ঘনত্ব কমে আসে অর্থাৎ হাড়ে ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য খনিজগুলির পরিমাণ কম হতে থাকে। এক্ষেত্রে হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে গাজরের উপকারিতা বহুবিধ। গাজর ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ, যা হাড় বৃদ্ধি ও মজবুত করতে সক্ষম।
আরও পড়ুন । স্বাস্থ্যের জন্য মেথির উপকারিতা আপনার জানা উচিত
6. স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে (Reduces the risk of stroke)
গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত গাজর খান তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে। তাই স্ট্রোকের হাত থেকে বাঁচতে আজ থেকেই গাজর খাওয়া শুরু করুন।
7. হার্ট ভালো রাখে (keeps Heart healthy)
গাজর খাওয়া হার্টের রোগীদের জন্যও খুব উপকারি। গাজরে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তাই হার্ট সুস্থ রাখতে, কাঁচা বা সিদ্ধ গাজর খাওয়ার উপকারিতার পাশাপাশি গাজরের রস করে খাওয়ার উপকারিতাও অনেক।
এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপকে হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই হৃদরোগ এড়াতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। গাজরে উপস্থিত পুষ্টিগুণ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
8. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে সহায়ক (controlling diabetes)
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সর্বপ্রথম তাদের খাদ্যের যত্ন নেওয়া সবচেয়ে দরকারি। এক্ষেত্রে গাজরকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ গাজরে উপস্থিত ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, ইনসুলিন প্রতিরোধকে প্রভাবিত করে ডায়াবেটিসের সাথে লড়াই করতেও বেশ উপকারি এই সবজি।
আরও পড়ুন ।স্বাস্থ্যের জন্য মসুর ডাল খাওয়ার উপকারিতা
-
ত্বকের উপকারিতা (Skin benefits)
1. ত্বককে শুষ্কতার হাত থেকে বাঁচায় (Protects the skin from dryness)
শীতকালে একটি বড় সমস্যা হল ত্বকের শুষ্কতা। শুষ্কতার সঙ্গে ধুলোবালির জন্য আমাদের ত্বক বিবর্ণ হয়ে পড়ে। আর এই শুষ্কতার থেকে মুক্তির সহজ পথ হল গাজরের ফেস মাস্ক। গাজরের ফেস মাস্ক আপনার রুক্ষ শুষ্ক ত্বককে প্রাণবন্ত করে তুলবে। গাজরের ফেস মাস্ক বানানোর পদ্ধতি নীচে দেওয়া রইল –
আরও পড়ুন । ৮ টি কালমেঘ পাতার উপকারিতা ও গুণাগুণ
উপকরণঃ-
- ৩ চা চামচ গাজরের রস
- ১ চা চামচ মিল্ক ক্রিম
- ১ চা চামচ শসার পেস্ট
প্রণালীঃ-
- গাজরের রস, মিল্ক ক্রিম এবং শসার পেস্ট একসঙ্গে মিশিয়ে নিন।
- এবার এই মিশ্রণটি পুরো গলা ও মুখে লাগিয়ে নিন। ১৫ মিনিট অপেক্ষা করে হালকা উষ্ণ গরম জলে ধুয়ে ফেলুন।
এই প্যাকটি আপনার ত্বককে ড্রি- হাইড্রেট রাখবে পাশাপাশি শুষ্কতার হাত থেকে মুক্তি দেবে।
আরও পড়ুন । ৮ টি ঘরোয়া উপাদানে ব্রণের দাগ দূর করার উপায়
2. সূর্যের ট্যান রিমুভ করে (Removes sun tan)
সূর্যের পোড়া ত্বকে উজ্জ্বলতা ফিরেয়ে আনতে গাজর ব্যবহার করতে পারেন। ত্বকের মৃত কোষের জন্য টান পড়ে বেশি। গাজরের ফেস প্যাক ত্বকের মৃত কোষগুলি রিমুভ করে ত্বক ব্রাইট করে।
আরও পড়ুন । ১০ টি ঘরোয়া পদ্ধতিতে মুখের কালো দাগ দূর করার উপায়
উপকরণঃ-
- এক টেবিল চামচ ডিমের সাদা অংশ
- এক টেবিল চামচ দই
- এক টেবিল চামচ গাজরের রস
আরও পড়ুন । চর্মরোগ | একজিমা কি, লক্ষণ এবং ঘরোয়া চিকিৎসা
প্রণালীঃ-
- উপকরণগুলি সব একসঙ্গে মিশিয়ে একটি প্যাক বানিয়ে নিন।
- এবার ১৫- ২০ মিনিট পর উষ্ণ গরম জলে ধুয়ে ফেলুন।
এই প্যাকটি ত্বক গ্লোয়িং করে তুলবে। ভালো ফল পেতে সপ্তাহে ২-৩ বার ট্রাই করে দেখুন।
3. ময়শ্চারাইজিং রাখে (Keeps moisturizing)
গাজর রস ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রেখে ত্বক ময়শ্চারাইজিং করে রাখে। বাজারে কেমিক্যালযুক্ত ময়শ্চারাইজিং ক্রিমের পরিবর্তে গাজরের তৈরি ময়শ্চারাইজিং ফেসিয়াল মাস্ক তৈরি করে নিতে পারেন। নীচে ফেসিয়াল মাস্ক বানানোর জন্য টিপস দেওয়া হল –
আরও পড়ুন । ভিটামিন ই ক্যাপসুল: ত্বকের জন্য ভিটামিন ই ক্যাপসুল
উপকরণঃ-
আরও পড়ুন । ৭ টি ঘরোয়া পদ্ধতিতে মেছতা দূর করার উপায়
প্রণালীঃ-
- সমস্ত উপকরণ এক সঙ্গে মিশিয়ে প্যাক বানিয়ে নিন।
- ভালো করে মুখ পরিষ্কার করে এই প্যাকটি লাগিয়ে নিন।
- এবার ১০ – ১৫ মিনিট বাদে ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুয়ে নেবেন।
4. দাঁতের যত্ন (Dental care)
ত্বকের পাশাপাশি গাজর দাঁতের জন্যও উপকারী। গাজরে উপস্থিত খনিজগুলি দাঁতের ক্ষতিকারক জীবাণুগুলির সঙ্গে লড়াই করে দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। তাই দাঁতের যত্নে নিয়মিত কাঁচা গাজর খাওয়া প্রয়োজন।
আরও পড়ুন । ব্রণ দূর করার উপায়ঃ চট জলদি ব্রণ দূর করুন
আশা করি, ১০ টি গাজরের উপকারিতা জেনে গেলেন। এবার সুস্থ থাকার জন্য আপনার খাদ্য তালিকায় গাজর যোগ করুন।
আরও পড়ুন । চুলের যত্নে ৫ টি জবা ফুলের উপকারিতা
Key point
রোজ গাজর কাঁচা খেলে সর্বোচ্চ পুষ্টি পাওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম। এই জন্য সুস্বাস্থ্য থাকার জন্য ডাক্তাররা গাজরের জুস খাওয়ার পরামর্শ দেন।
আরও পড়ুন । চুল ঘন করার উপায়ঃ ৯ টি আশ্চর্যজনক পদ্ধতি
সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন উত্তরঃ
Q. গাজর রোজ খাওয়া কি ভালো?
A. গাজর ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবারে পূর্ণ যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তবে কিছু উজ্জ্বল কমলা রঙের গাজর রয়েছে যা অতিরিক্ত রক্তের ক্যারোটিনকে বাড়িয়ে তুলতে পারে যা ত্বককে বর্ণহীন করতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিমাপমত খাওয়াই ভালো।
Q. গাজর কি চুলের জন্য ভালো?
A. গাজরে ভিটামিন এ রয়েছে, যা চুল মজবুত করতে সহায়তা করে।
Q. গাজর খেলে কি ওজন বাড়ে?
A. না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
Q. গাজর কি চোখের জন্য ভালো?
A. হ্যাঁ, গাজর চোখের দৃষ্টি ভালো রাখে।
Q. গাজর ত্বকের জন্য কি উপকার?
A. গাজরে বিটা ক্যারোটিন রয়েছে ত্বকের প্রদাহ হ্রাস করে।