আপনার চোখ এবং ত্বক কি হলুদ হয়ে যাছে, তাহলে আপনার জন্ডিস হওয়ার সম্ভবনা আছে। জন্ডিসের লক্ষণ বাচ্চাদের মধ্যে বেশি দেখা গেলেও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই রোগটি হওয়ারও সম্ভবনা কিছু কম নয়।
চোখের সাদা যে অংশটি রয়েছে, সেটি হলুদ হয়ে গেলে সাধারণত বলা হয়ে থাকে জন্ডিস। জন্ডিস ভিন্ন ধরনের রয়েছে এবং জন্ডিসের লক্ষণও ভিন্ন। জন্ডিসের মাত্রা যখন বেশি হয়ে যায় তখন আমাদের শরীরে বাকি অংশগুলি হলুদ হতে শুরু করে এমন কি ইউরিন (Urine) হলুদ রঙের হয়।
এখনকার দিনে জন্ডিসের সঠিক চিকিৎসা করলে সুস্থও হয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু তার আগে সময়মত চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। কিন্তু আপনি যে জন্ডিসে আক্রান্ত, সেটা বুঝবেন কেমনভাবে? তাই আজ আপনাদের জন্য আজকের এই নিবন্ধ। এই নিবন্ধ থেকে জেনে নিন জন্ডিস কেন হয়, জন্ডিসের লক্ষণ (Symptom Of Jaundice) এবং তার চিকিৎসা।
জন্ডিস কি – What is Jaundice?
সাধারণ ভাষায় বোঝাতে গেলে জন্ডিস কিন্তু কোনো রোগ নয়, রোগের লক্ষণ মাত্র। জন্ডিস এমন একটি রোগের লক্ষণ, যা আমাদের সারা দেহকে হলুদ করে দেয়।
প্রকৃতপক্ষে যখন লাল রক্তের কোষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভেঙে যায় অর্থাৎ 120 দিনের মধ্যে, তখন বিলিরুবিনের মতো একটি পদার্থ গঠন হয়। এই পদার্থ যখন যকৃতের মধ্যে যায় এবং তা ধীরে ধীরে মল- মুত্রের সঙ্গে বেরিয়ে যায়।
যদি কিছু দিনের মধ্যে লাল রক্তের কোষ ভেঙে যায় এবং লিভারে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন জন্ডিস হয়। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বাড়ার কারণেই ত্বক, চোখ হলুদ হয়ে যায়। তবে জন্ডিসের লক্ষণ নজরে এলেই চিকিৎসা করানো দরকার।
আরও পড়ুন । ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণঃএই লক্ষণগুলি দেখলেই বুঝবেন ডেঙ্গু জ্বর
জন্ডিসের কারণ – Cause of jaundice
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিস হয় তা তো আগেই জানালাম। তবে, জন্ডিসের আরেকটি প্রধান কারণ হল লিভার। অনেক সময় লিভার সংক্রান্ত সমস্যার জন্য জন্ডিস হয়ে থাকে। আবার অনেকের ধারণা মতে হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাসের কারণেও জন্ডিস হয়ে থাকে। এটি একটি বংশগত রোগ।
আরও পড়ুন । ডেঙ্গুর লক্ষণ ও প্রতিকার, পরীক্ষা, প্লেটলেট
জন্ডিসের ধরন – Types Of Jaundice
Pre-Hepatic Jaundice: এই ধরণের জন্ডিস লাল রক্ত কোষের অতিরিক্ত ভাঙ্গন দ্বারা সৃষ্ট হয়, যা লিভার বিলিরুবিন বিপাক করার ক্ষমতা অতিক্রম করে।
Hepatocellular Jaundice: যখন আপনার লিভার বিলিরুবিন বিপাক করার ক্ষমতা হারায়, তখন এটি Hepatocellular Jaundice এ পরিনত হয়।
Post- Hepatic Jaundice: যখন শরীর থেকে বিলিরুবিন বেড়ানোর সময় বাঁধার সৃষ্টি হয়, তখন Post- Hepatic Jaundice এ পরিণত হয়।
আরও পড়ুন । ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধঃ ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার উপায়
জন্ডিসের লক্ষণ – Symptom Of Jaundice
১. শরীর হলুদ হয়ে যাওয়া (Yellowing of the body)
জন্ডিসে আক্রান্ত হলে শরীর হলুদ হয়ে যায়। জন্ডিসের শুরুর দিকে দেখলে তেমন বোঝা নাও যেতে পারে, তবে যতদিন যাবে ধীরে ধীরে শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করবে।
শরীরে কিছু কিছু অংশে লক্ষ্য করলে আপনি এই ধরণের লক্ষণগুলি দেখতে পাবেন। প্রধান জন্ডিসের লক্ষণ হল শরীরের বিভিন্ন অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া।
২. নখের রং হলুদ হয়ে যাওয়া (The nails turn yellow)
জন্ডিস কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে ডাক্তার প্রথমে রোগীর নখ লক্ষ্য করে। এর কারণ হল জন্ডিসে নখ হলুদ হয়ে যায়। খেয়াল করে দেখবেন আমাদের নখের উপরে চিপে ধরলে রক্ত দেখা যায়। তাই জন্ডিস বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হল নখ।
আপনার নখটি ক্ষণিকের জন্য চিপে রাখুন, যদি লাল রং দেখতে পান তাহলে মনে করবেন আপনি সুস্থ। কিন্তু যদি হলুদ রং দেখতে পান তাহলে আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।
৩. চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া (Yellowing of the white part of the eye)
জন্ডিসের লক্ষণ চেনার আরও একটি উপায় হল চোখ। জন্ডিস হওয়ার প্রথম লক্ষণ চোখের সাদা অংশ ধীরে ধীরে হলুদ রং হয়ে যায়।
৪. হাতের তালু (Palm)
হাতের তালু দেখেও আপনি খুব সহজেই বুঝতে পারবেন আপনার জন্ডিস হয়েছে কিনা। নখের মতোই হাতেও আমাদের রক্ত দেখা যায়। আপনার দুটি হাতের তালু একসঙ্গে ঘষে নিন এবার ভালোভাবে দেখুন যে হাতের তালুতে আপনি কেমন রক্ত দেখতে পাছেন। যদি দেখেন হলুদ তাহলে ভাববেন আপনি জন্ডিসে আক্রান্ত।
আরও পড়ুন । হেপাটাইটিস বি এর চিকিৎসা ও লক্ষণ
৫. হলুদ রঙের ইউরিন (Yellow urine)
হলুদ রঙের ইউরিন হওয়াও জন্ডিসের লক্ষণ। জন্ডিস হওয়ার সময় ইউরিন গাঢ় হলুদ রঙের হয়ে যায়। আবার অনেকের হালকা হলুদ রঙের ইউরিন দেখতে পাওয়া যায়।
৬. ক্লান্তি ভাব (Feeling tired)
জন্ডিসের সর্বাধিক সাধারণ লক্ষণ ক্লান্তি। জন্ডিসে শরীর ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়।
৭. জ্বর (Fever)
জন্ডিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীর হলুদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর জ্বর ভাব আসে। আবার অনেক সময় প্রচণ্ড জ্বর আসে। এইরকম লক্ষণ দেখলে চিকিৎসা করানো প্রয়োজন।
৮. পেট ব্যথা ও বমি বমি ভাব (Nausea and Abdominal pain)
জন্ডিস হলে জ্বরের পাশাপাশি বমি বমি ভাব হয়। সঠিকভাবে চিকিৎসা না করানো হলে খুব বড় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। জন্ডিসে আক্রান্ত হলে অনেক সময় জ্বর এবং বমির সঙ্গে অসহ্য পেটে যন্ত্রণা হয়।
৯. ওজন কমে যাওয়া (weight loss)
জন্ডিস, যা সরাসরি আমাদের লিভারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। আর সেই সাথে লিভারে কোন সমস্যা দেখা দিলে খিদে কমে যাওয়ার প্রবণতা ক্রমশ বেড়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে ওজন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায়।
Key point: জন্ডিসের কারণে শরীরে কয়েকটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই সমস্ত লক্ষণগুলি বুঝতে পারলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করান।
আরও পড়ুন । ইউরিক অ্যাসিড কমানোর ঘরোয়া উপায়
জন্ডিসের চিকিৎসা – Jaundice Treatment
ঘরোয়া পদ্ধতিতে আপনি অবশ্যই জন্ডিসের চিকিৎসা করাতে পারেন। তবে তার আগে আপনার ডাক্তারের চিকিৎসা প্রয়োজন। ডাক্তারের চিকিৎসার পাশাপাশি নীচে দেওয়া ঘরোয়া পদ্ধতিতে আপনি জন্ডিসের চিকিৎসা করতে পারেন।
-
তুলসীপাতা (Holy Basil):
তুলসীপাতা লিভারের জন্য খুব ভালো পাশাপাশি জন্ডিসের চিকিৎসায়ও কার্যকর।
উপকরণঃ
১০-১২ টি তুলসীপাতা
যা করতে হবেঃ
১০-১২ টি তুলসীপাতা নিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিন। যদি কাঁচা খেতে না পারেন, তাহলে পাতাগুলি পেস্ট করে যেকোনো জুসের সঙ্গে খেতে পারেন।
-
ভিটামিন ডি (Vitamin D):
জন্ডিস আক্রান্ত রোগীদের ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন। খাবারের তালিকায় Vitamin D যুক্ত খাবার রাখবেন।
-
আঙুরের ফলের রস ( Grape Juice):
আঙ্গুরের ফলের রস লিভারের জন্য কার্যকারী এবং শরীরের হলুদ ভাব কমাতে সাহায্য করে এবং জন্ডিসের জন্য উপকৃত।
উপকরণঃ
পরিমাণমতো আঙুর
যা করতে হবেঃ
কয়েকটি আঙুর পেস্ট করে রস বের করে নিন। নিয়মিত এক গ্লাস আঙুরের রস খান।
আরও পড়ুন । লিভার ক্যান্সার কেন হয় এবং লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ
-
সূর্যের আলো (Sunlight):
শিশুদের জন্ডিসের নিরাময়ের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হল ফোটোথেরাপি। তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে শিশুদের জন্য জন্ডিস চিকিৎসায় ফোটোথেরাপির চেয়েও সূর্যলোকের এক্সপোজার বেশি কার্যকারী।
-
লেবুর রস (Lemon Juice):
উপকরণঃ
হাফ লেবু
এক গ্লাস জল
পরিমাণমতো মধু
প্রণালীঃ
এক গ্লাস জলে হাফ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। এবার আপনার পরিমাণমতো মধু মিশিয়ে পান করুন। দিনে ৩-৪ বার পান করুন।
-
আখের রস (Sugarcrane Juice):
আখের রস লিভারকে আরও শক্তিশালী করে তোলে এবং এটি জন্ডিসের জন্য একটি উত্তম চিকিৎসা।
উপকরণঃ
এক গ্লাস বা দু’গ্লাস আখের রস
যা করতে হবেঃ
নিয়মিত এক বা দু’গ্লাস আখের রস পান করতে হবে (যতক্ষণ না পর্যন্ত জন্ডিস কম হয়)।
-
অড়হড় পাতা
দ্রুত জন্ডিস থেকে রেহাই পেতে অড়হড় পাতা খুবই কার্যকরী একটি উপাদান।
যা করতে হবেঃ প্রতিদিন ২ থেকে ৩ চামচ অড়হড় পাতার রস পান করতে হবে (প্রয়োজনে এতে লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে)।
-
পেঁপে পাতা
জন্ডিসের মত রোগের নিরাময়ে ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে পেঁপে পাতার উপকারিতা অপরিসীম।
যা করতে হবেঃ ১ চামচ পেঁপে পাতার রসের সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খেতে হবে (যতক্ষণ না পর্যন্ত জন্ডিস পুরোপুরি ভাবে সেরে যায়)।
Key point: এই ঘরোয়া পদ্ধতিগুলির পাশাপাশি অবশ্যই আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শে চলতে হবে।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন উত্তরঃ
Q. জন্ডিস রোগীদের জন্য উপযুক্ত খাবার কি?
A. জন্ডিস রোগীদের জন্য উপযুক্ত ফল, শাক সবজি, মাছ, শস্য দানা, বাদাম ইত্যাদি প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়া উচিৎ। জন্ডিসে ডাবের জল দারুণ উপকারী একটি তরল।
Q. জন্ডিসে আক্রান্ত হলে কি পুরো শরীর হলুদ হয়ে যায়?
A. বিশেষ করে মুখ, নখ, হাত, পা হলুদ হয়ে যায়।
Q. জন্ডিস ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে কি ভালো হওয়া সম্ভব?
A. ঘরোয়া পদ্ধতির পাশাপাশি অবশ্যই ডাক্তারের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
জন্ডিসের জন্য কি কি পরীক্ষা করতে হয়?
জন্ডিস হলে আখের রস কতদিন খেতে হবে?
কীভাবে বুঝব জন্ডিস হলে
আঙুরের ফলের রস খেলে জন্ডিস কমবে?
জন্ডিসে কি খাবার খেতে হবে?
রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি বিলিরুবিন পরীক্ষা, মূত্র পরীক্ষা এবং লিভার ফাংশন পরীক্ষা করতে হয়।
শরীর হলুদ হয়ে যায়, নখের রং হলুদ হয়ে যায়, চোখের সাদা অংশ ও হাতের তালু হলুদ হয়ে যায়। এইধরনের লক্ষণগুলি সাধারণত দেখা যায়।
নিয়মিত এক বা দু’গ্লাস আখের রস পান করতে হবে।
আঙ্গুরের ফলের রস লিভারের জন্য কার্যকারী এবং শরীরের হলুদ ভাব কমাতে সাহায্য করে এবং জন্ডিসের জন্য উপকৃত।
জন্ডিস আক্রান্ত রোগীদের ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন।
Jaundicehole ki prosrab’er pot jala Kore o Halka blood berhoi?
জন্ডিস হলে হলুদ রঙের ইউরিন দেখা যায়। তবে প্রস্রাবে জায়গায় জ্বালা অথবা হালকা ব্লাড বেরানো ইউরিন ইনফেকশনের কারণে হতে পারে। দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
সেরাম বিলুরুবিন
ও এস জি পি টি