উইকেন্ডে দারিংবাড়ি ভ্রমণ মানেই ওড়িশার কাশ্মীর উপভোগ। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই কাশ্মীর তাও আবার ওড়িশায়। হ্যাঁ এতাই বাস্তব, ওড়িশা ভ্রমণ করার কথা বলতেই আমাদের মনের মধ্যে আসে পুরী নয় ভুবনেশ্বর। তবে এর আনাচে কানাচে এমন অনেক সুন্দর ভ্রমণ স্থল রয়েছে যা আমাদের অনেকেরই অজানা এবং শুনতে কিছুটা আশ্চর্য হতে পারেন। ওড়িশার কাছেই রয়েছে দারিংবাড়ি। আর এটি এমন একটি জায়গা যাকে বলা হয় “Kashmir of Odisha” (কাশ্মীর অফ ওড়িশা)।
ওড়িশার দারিংবাড়ি খুব সুন্দর একটি হিল স্টেশন। সত্যিই ভাবলে অবাক লাগে ওড়িশার ভেতরই রয়েছে এমন একটি আশ্চর্যজনক জায়গা। তাই উইকেন্ডে এক চমৎকার ভ্রমণ পেতে ও বরফের মজা পেতে চাইলে পরবর্তী ডেস্টিনেশন হোক দারিংবাড়ি। তবে ভ্রমণ করার আগে দারিংবাড়ি যাওয়ার জন্য সমস্ত কিছু জেনে নিতে হবে। আসুন আজ আমরা এই নিবন্ধে দারিংবাড়ি ট্র্যাভেল গাইড শেয়ার করব।
ওড়িশার কাছেই দারিংবাড়ি (Daringbari near Orissa)
পূর্ব ভারতের ওড়িশা রাজ্যের দারিংবাড়ি একটি দৃষ্টিনন্দন জলবায়ু। পাহাড় এবং চারপাশের সৌন্দর্যের জন্য এটি পরিচিত। এটি একটি হিল স্টেশন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই পাহাড়। আর পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্য মুখে বলে হয়তো বোঝানো সম্ভব নয়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে কাশ্মীরের কথা মনে করিয়ে দেবে। শীতকালে গেলে হয়তো বরফ পড়ার দৃশ্যও উপভোগ করতে পারবেন। এছাড়াও রয়েছে পাইন বন, গোলমরিচের বাগান ও কফি বাগান। কফি বাগান আপনি ঘুরতে পারবেন এবং এখানকার হিল ভিউ পয়েন্ট থেকে দারিংবাড়ি এলাকাটি পুরো দেখতে পারবেন।
ইতিহাস (History)
প্রাথমিকভাবে, জায়গাটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি, ডেরিং সাহেবের নাম অনুসারে ডেরিংবাড়ি নামে পরিচিত হতে শুরু করে। তিনি জায়গাটির প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। ধীরে ধীরে বানানটি দারিংবাড়িতে পরিবর্তিত হয়।
Read more : কক্সবাজার ট্র্যাভেল গাইড/ বাংলাদেশ
লোকেশন (Location)
দারিংবাড়ি ওড়িশার কন্ধমাল জেলায় এবং ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় ২৫২ কিলোমিটার দূরে, ৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
যাতায়াত ব্যবস্থা (Transportation system)
আকাশপথ (By plane):
আপনি যদি বিমানের মাধ্যমে পৌঁছতে চান তবে আপনি ভুবনেশ্বরে যেতে পারেন যা নিকটতম বিমানবন্দর এবং দারিংবাড়ি থেকে আপনি ট্যাক্সি ভাড়া করে নিতে পারেন।
সড়কপথ (By bus and train):
বিশাখাপত্তনম: দারিংবাড়ির নিকটতম রেল স্টেশন বেরামপুর। আর বিশাখাপত্তনম থেকে বেরামপুর দূরত্ব ২৭৭ কিমি। ট্রেনে যেতে সময় লাগবে ৪-৫ ঘণ্টা মতো। আপনি দারিংবাড়ি পৌঁছানোর জন্য একটি ট্যাক্সি নিয়ে যেতে পারেন।
বেরামপুর দারিংবাড়ি পৌঁছানোর জন্য আপনি একটি ব্যক্তিগত ক্যাব বা পাবলিক বাস পরিষেবা নিতে পারেন।
ভুবনেশ্বর: ভুবনেশ্বর থেকে দারিংবাড়ির দূরত্ব ২৫০ কিমি। ভুবনেশ্বর থেকে বাসে দারিংবাড়ি পৌঁছানো যায়।
কলকাতাঃ কলকাতা থেকে আপনাকে ট্রেনে ভুবনেশ্বর যেতে হবে। ভুবনেশ্বর থেকে বাসে বা ট্রেনে দারিংবাড়ি পৌঁছানো যায়।
আবহাওয়া (climate)
গ্রীষ্মে দারিংবাড়ির আবহাওয়া গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়া অনুভব করতে পারেন। তখন সম্ভবত তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২২ থাকে।
বর্ষাকালে এখানে বৃষ্টি হয় এবং চারিদিক সবুজ রঙে পূর্ণ থাকে। এবং শীতকালে এখানে দারুন শীত পড়ে এবং এখানে ঘোরার আসল সময় এটি। ডিসেম্বর মাসে পারদ রাতের সময় ০ ডিগ্রি নেমে যায়। সকালের সময় আপনি ঘন কুয়াশা অনুভব করতে পারেন এবং মধ্যাহ্নে আপনি নীল আকাশ, সবুজ পরিবেশের অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। আর আপনার ভাগ্য যদি ভালো থাকে বরফ পড়ার দৃশ্যও উপভোগ করতে পারেন।
Read more : দার্জিলিং ভ্রমণ/ লোকেশন/ যাতায়াত ব্যবস্থা/ঘোরার জায়গা
খাবার (Food)
প্রাতঃরাশের জন্য রাস্তার পাশে কয়েকটি ভোজনশালা রয়েছে। আপনি সেখান থেকে পুরী, ইডলি এবং উপমা খেতে পারেন। মধ্যাহ্নভোজ ও রাতের খাবারের জন্য হিল ভিউতে ভালো রেস্তোঁরা রয়েছে।
ভ্রমণ স্থান/ দর্শনীয় স্থান (Traveling place/ sightseeing)
দুলুরি নদী জলপ্রপাতঃ
দারিংবাড়ির সবচেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই দুলুরি নদী। পাইন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সশব্দে বয়ে চলছে দুলুরি নদী সঙ্গে রয়েছে তার সুদৃশ্য জলপ্রপাত। নদীর পথটি বনের মধ্যে দিয়ে। এই জলপ্রপাতের দৃশ্য অপূর্ব। নদীর ধার বেশ মনোরম। আপনি এই জলপ্রপাতে বসে আরাম করতে পারবেন।
মড়ুবান্দা জলপ্রপাতঃ
দারিংবাড়ি থেকে ১৫ কিমি দূরেই বামুনিগ্রাম। আর এই বামুনিগ্রাম যাওয়ার পথে ঘন অরণ্যের মধ্যেই আপনি দেখতে পারবেন এই জলপ্রপাত। পাইন গাছে ঘেরা এই জলপ্রপাত। জলপ্রপাতের পুরো পথ ধরে সিঁড়ি রয়েছে। জায়গাটি বেশ নিরিবিলি এবং বেশ সুন্দর।
লুদু জলপ্রপাতঃ
দারিংবাড়ি থেকে প্রায় ১৪০ কিমি দূরে অবস্থিত রয়েছে এই লুদু জলপ্রপাত। এই জলপ্রপাত ১০০ ফুট উচ্চ এবং এটি বুনো হাতিদের ঘন জঙ্গলে অবস্থিত। ভ্রমণ পর্যাটকদের এই জায়গাটি বেশ মন আকর্ষিত করে তুলবে।
পাইন অরণ্যঃ
দারিংবাড়ি থেকে ২ কিমি গেলেই দেখতে পাবেন পাইন অরণ্যের সমারোহ। এই পাইন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে সশব্দে আপন মনে বয়ে চলেছে দুলুরি নদী জলপ্রপাত। এই পাইন অরণ্যটি মড়ুবান্দা জলপ্রপাতের পথেই অবস্থিত।
Read more : পুরী ভ্রমণ/লোকেশন/যোগাযোগ ব্যবস্থা/ভ্রমণের স্থান
কফি ও মশলা বাগানঃ
দারিংবাড়ি ভ্রমণে গেলে একটা জায়গা মিস করলে একেবারেই আপনার লস। সেটা হল কফি এবং মশলার বাগান। দারিংবাড়ি বাজার থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে গেলেই পেয়ে যাবেন কফি ও মশলার বাগান। বাগানে ঢোকার টিকিট ২০-৩০ টাকা। বাগানে ঢুকলেই আপনি দেখতে পাবেন লাল- সবুজ কফির গাছ। কফি বাগান থেকে আপনাদের ঘুরতে বেশ ভালোই লাগবে। এমনকি সেখানে গোলমরিচ এবং হলুদের বাগান।
হিল ভিউ পার্ক ও হিল ভিউ পয়েন্টঃ
দারিংবাড়ি থেকে মাত্র এক কিমি দূরে রয়েছে বালিগুডা। আর তার যাওয়ার পথেই রয়েছে হিল ভিউ। হিল ভিউ সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় উপভোগ করার জন্য উপযুক্ত জায়গা। এই হিল ভিউ পার্কের মধ্যেই রয়েছে বাটারফ্লাই পার্ক। হিল ভিউ পার্কের ঠিক বিপরীতে হিল ভিউ পয়েন্ট রয়েছে।
হিল ভিউ পয়েন্টের ওয়াচ টাওয়ার থেকে আপনি সমগ্র দারিংবাড়ি পাহাড় এবং গোটা দারিংবাড়ি দেখতে পাবেন। এটি একটি দারুন দৃশ্য বলে বোঝানোর মতো নয়। হিল ভিউ পার্কের মধ্যে একটি সুন্দর সু-রক্ষণাবেক্ষণ বাগান রয়েছে। ফুলের বাগান, ঔষধি গাছের বাগান এবং বাটারফ্লাই বাগান রয়েছে যেখানে আপনি বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপ্রতি দেখতে পাবেন।
লাভার্স পয়েন্ট:
দারিংবাড়ি থেকে বালিগুডা যাওয়ার পথে কিরিকুটি নামক একটি গ্রামে ঘন অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত লাভার্স পয়েন্ট। লাভার্স পয়েন্ট জায়গাটি রুক্ষ হলেও তার প্রাকৃতিক শোভা কিন্তু অতুলনীয়। তাই না গেলে মিস করবেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ছোট বসন্ত।
সৌন্দর্যে ঘেরা এই পরিবেশকে পাহাড়ি নদীর শব্দ আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বড় বড় পাথর রয়েছে যার উপরে বসে কিছুটা শান্ত সময় উপভোগ করতে পারবেন। প্রকৃতির নিঃশব্দতা অনুভব করার জায়গা। সম্ভবত প্রকৃতির সাথেই এর প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে তাই হয়তো নাম দেওয়া হয়েছে লাভার্স পয়েন্ট। সুতরাং আপনার দারিংবাড়ি সফরে এই জায়গাটি মিস করা একদমই উচিত নয়।
Read more : মন্দারমণি সমুদ্র সৈকত/ লোকেশন/ যোগাযোগ ব্যবস্থা/ ভ্রমণের স্থান
সানসেট পয়েন্ট বা সাইলেন্স ভ্যালিঃ
এই জায়গাটি দারিংবাড়ি শহর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং আসলে এটি একটি দৃষ্টিকোণ। সানসেট পয়েন্ট পুরো উপত্যকাটি দেখা যায় এবং এই উপত্যকা থেকে যে কেউ দর্শনীয় সূর্যাস্ত এক ঝলক দেখতে পায় এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্য সেরা জায়গা।
এমু পাখি সাফারি/ এমু ফার্মঃ
এমু ফার্ম দারিংবাড়ি শহর থেকে বালিগুডা যাওয়ার পথে প্রায় ১২ কিমি দূরে। এখানে একটি ছোট ফার্ম রয়েছে যেখানে এমু পাখি রাখা। পর্যটকদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় জায়গা।
বেলঘর অভয়ারণ্যঃ
হিল ভিউ পয়েন্ট ছাড়াও আপনি বেলঘর অভয়ারণ্যের রোমাঞ্চকর ভ্রমণ উপভোগ করতে পারেন। দারিংবাড়ি থেকে ৫০ কিমি দূরেই রয়েছে বেলঘর অভয়ারণ্য। ক্রান্তীয় অরণ্যভুমি এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। জায়গাটি পুরো মনোরম দৃশ্যবলি, পাহাড়, বন এবং বন্য প্রাণী এবং বিশেষত হাতি এখানের বড় আকর্ষিত। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও বিপন্ন প্রজাতির পাখি রয়েছে। বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীজগতে বেলঘর অভয়ারণ্য জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে একটি সমৃদ্ধ স্থান।
Read more : দীঘা ভ্রমণ, সমুদ্র সৈকত, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন উত্তরঃ
Q. দারিংবাড়ি যাওয়ার উপযুক্ত সময় কোনটি?
A. দারিংবাড়ি যাওয়ার উপযুক্ত সময় শীতকাল।
Q. দারিংবাড়িতে বরফ পড়ার দৃশ্য কি দেখা যায়?
A. শীতকালে রাতের বেলা ০ ডিগ্রি তে নেমে যায়। সবসময় বরফ পরা দেখা যায় না। কিছু কিছু সময় সম্ভবত পড়ে।
Q. দারিংবাড়ি ভ্রমণ কি সস্তা?
A. কাশ্মীরের থেকে এর খরচ অনেক কম।
Q. দারিংবাড়ি কি হুবহু কাশ্মীরের মতো?
A. কাশ্মীরের মতোই এর প্রাকৃতিক দৃশ্য। এছাড়াও এটিকে ছোট কাশ্মীর বলা হয়।