দোল পূর্ণিমা বাংলার বসন্ত উৎসব 2024 । বৃন্দাবনের দোল উৎসব

দোল পূর্ণিমা বাংলার বসন্ত উৎসব

দোল পূর্ণিমা, বাংলার বসন্ত উৎসব। প্রতি বছর বাঙালীরা এই দিনটিতে রঙ খেলায় আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে।  দোলযাত্রা যেন বসন্তের আহ্বান। এই উৎসবটি যেন জানিয়ে দেয় শীত বিদায় নিয়েছে, এসেছে বসন্তের ছোঁয়া। এই দিনটিতে বাঙালিরা একে অপরকে রঙে রাঙিয়ে দেয়। এই দিনে বাতাসে যেন একটাই সুর বয়ে চলে “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে”। এই বসন্ত উৎসবকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি যেন এক বর্ণিল সাজে সেজে ওঠে।

আরও পড়ুন >>  হোলির শুভেচ্ছা : হোলি শুভেচ্ছার ম্যাসেজ

দোল পূর্ণিমা ভিন্ন নামে অভিহিত। কোথাও এই দোল পূর্ণিমাকে দোল যাত্রা বলে। আবার ফাল্গুনী পূর্ণিমাকেও দোল পূর্ণিমা বলা হয়ে থাকে। মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের জন্ম হয়েছিল এই পূর্ণিমার তিথিতে, তাই দোল পূর্ণিমাকে গৌরী পূর্ণিমা বলা হয়। দোল পূর্ণিমা অনেক পৌরাণিক ঘটনা। এই তিথিতে বৃন্দাবনে আবির ও গুলাল নিয়ে শ্রী কৃষ্ণ, রাঁধা এবং তার গোপীগনের সঙ্গে হোলি খেলেছিল আর সেই ঘটনা থেকে উৎপত্তি হয় দোল খেলা।

দোল পূর্ণিমা

দোল পূর্ণিমার মূল আকর্ষণ আবির। এই দিনটি আবিরের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার দিন। এই দিনের পূজিত ঈশ্বর রাঁধা-কৃষ্ণ। বাঙালির দোলযাত্রাটি রাঁধা কৃষ্ণকে ঘিরেই। তাকে দোলায় বসিয়ে ওই দিনে পূজিত করা হয়। কিন্তু কেন এই দোলযাত্রা? কীভাবেই বা এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয়। আজকের আর্টিকেলে বাঙালির আনন্দের উৎসব দোলযাত্রা নিয়ে কথা বলব। আসুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক দোল পূর্ণিমার সব খবরাখবর।

দোল পূর্ণিমা বাংলার বসন্ত উৎসব (Dol Purnima Bengal spring festival) 

দোল শুধুমাত্র বাঙালিদের উৎসব না, সারা বিশ্বজুড়ে দোল পূর্ণিমা পালন হয় শুধু আলাদা নামে। সারা বিশ্বজুড়ে এই উৎসবটি “হোলি” নামে পরিচিত। কিন্ত এই উৎসবের দিনই শুধু রঙ খেলা হয়। অন্য উৎসবে হয় না কেন? এর পিছনে একটা কাহিনি রয়েছে। দোল পূর্ণিমার পিছনে কাহিনী নীচে রইল।

দোল পূর্ণিমার দিনে রঙ খেলার কারন (Reasons to play colour of Dol Purnima)

দোল পূর্ণিমার দিনে রঙ খেলার কারনঃ

দোল সাধারণত পূর্ণিমা তিথিতে পালন করা হয়। দোল এবং হোলি দুটি আলাদা অর্থ হলেও দুটি একই জিনিস। এর পিছনে কারণও এক। হোলি কথাটি “হোলিকা” থেকে সৃষ্ট হয়েছে। যদিও গল্পটি বেশিরভাগ মানুষেরই জানা।

হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ এবং দিতির ছেলে হিরণ্যকশিপুর বোন। আর হিরণ্যকশিপুরের ছেলে ছিলেন প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদ অসুরবংশে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও ছিলেন প্রভু বিষ্ণুর ভক্ত। এর জন্য তার পিতা তার উপর ক্রুদ্ধ ছিলেন। কারন সে প্রভু বিষ্ণুকে তার বাবার উপর স্থান দিয়েছিলেন। তাই তার পিতা সিধান্ত নিয়েছিলেন নিজের ছেলেকে হত্যা করবেন।

  • হোলিকা দহন (Holika Dahan)

প্রহ্লাদ ধার্মিক ছিলেন। তাই তাকে হত্যা করা সহজ ছিল না। কোনোভাবেই তাকে হত্যা করা যাচ্ছিল না। তখন হিরণ্যকশিপুর তার ছেলেকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে হোলিকা আগুনে কোন দিন ক্ষতি হবে না এই বর পেয়েছিল। তাই প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য হোলিকা সিধান্ত নেয় সে প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেবে। এবং সে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে একদিন আগুনে ঝাঁপ দেয়।

কিন্তু হোলিকার বর পাওয়া সত্ত্বেও সেদিন শেষ রক্ষা হয়নি। প্রহ্লাদ তো বিষ্ণুর আশীর্বাদে বেঁচে যায়। কিন্তু আগুনে ভস্ম হয়ে যায় হোলিকা। সে তার বরের অপব্যবহার করায় আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার সময় তার বর নষ্ট হয়ে যায় এবং সে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই দিনটি থেকে পালন করা হয় হোলি বা দোল উৎসব।

হোলিকা দহন

হোলিকার এই কাহিনি চাঁচর বা হোলিকা দহন নামে পরিচিত, যা দোলের আগের দিন পালন করা হয়। অথবা যা সাধারণত নেড়াপোড়া বলে অভিহিত। নেড়াপোড়া দিন শুকনো ডালপালা, গাছের শুকনো পাতা দিয়ে বুড়ির ঘর তৈরি করা হয়। এবং হোলিকার উদ্দেশ্যে সেই ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হোলিকাদহন পালন করা হয়।

অনেক আবার হোলিকার উদ্দেশ্যে মাটির পুতুল বানিয়ে ওই শুকনো ডালপালার ঘরে রেখে জ্বালিয়ে দেয়। ওই দিনটি মানুষ নানা ভাবে পালন করে থাকে। এবং পরের দিন হয় দোল উৎসব।

আরও পড়ুন >> মহা শিবরাত্রি উদযাপন | Wishes and Quotes

  • ভিন্ন মতামত (Different opinion)

আবার বসন্ত পূর্ণিমার দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, কেশি নামে একজন অসুরকে বধ করেন। কেশি একজন অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর অসুর ছিলেন। এর জন্য এই অত্যাচারী অসুর দমন হওয়ার জন্য এবং অন্যায় শক্তি ধ্বংস হওয়ার জন্য আনন্দ উৎসবে এই দিনটি উদযাপিত হয়ে থাকে।

অন্যদিকে বৈষ্ণবরা বিশ্বাস করতেন দোল পূর্ণিমার দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রাধাকে আবির মাখিয়ে রঙ খেলায় মেতে ছিলেন। এবং সঙ্গে ছিলেন তাদের গোপীগন। তারপর থেকে দোলের দিন আবির নিয়ে রঙ খেলার সূচনা হয়।

Back To Top

দোল পূর্ণিমা উৎসব পালন (Celebrating of Dol Purnima festival)

দোল পূর্ণিমা উৎসব পালনঃ

দোলযাত্রা উৎসবে যেহেতু রঙের উৎসব, তাই এই উৎসবের প্রাণকেন্দ্র আবির। এই দিন সকাল সকাল আট থেকে আশি সকলে রাস্তায় একে অপরকে আবির মাখাতে নেমে পরে। আগে আবির দিয়ে খেলার প্রচলনটা বেশি ছিল কিন্তু পরে আবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রঙ। অবশ্য আজকাল আবার দোলের দিন আবির দিয়ে দোল খেলার রীতি ফিরে আসছে। দোলের সাত দিন আগে থেকেই দোকানদাররা রঙের পসরা সাজিয়ে বসে।

আরও পড়ুন >> 35 টি সরস্বতী পূজার শুভেচ্ছা বার্তা | 202৪

  • শান্তিনিকেতনে দোল পূর্ণিমা উৎসব পালন (Dole Purnima festival celebrating in Santiniketan)

শান্তিনিকেতনে দোল পূর্ণিমা উৎসব পালন

এই দিনটি শান্তিনিকেতনে বিশেষভাবে পালিত হয়। আগে কিন্তু শান্তিনিকেতনে দোল পূর্ণিমায় দোল উৎসব পালন হত না বরং বসন্তকে আহ্বান জানানোর জন্য সঙ্গীত, নৃত্য অনুষ্ঠান, নাট্য অভিনয়কে কেন্দ্র করে বিশেষ অনুষ্ঠান করা হত। কিন্তু পরবর্তীকালে ঘটনা একটু আলাদা ছিল।

বসন্ত উৎসবটি পরিব্যপ্ত হয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এখন সেটা দোল বসন্ত উৎসব হিসাবে পরিচিত। এবং এই দিন সকালে তারা রাস্তায় প্রভাত ফেরি বার করে আবির খেলতে খেলতে ” ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল” গানটি গায়। এবং নৃত্যের তালে তালে সারা আকাশ জুড়ে আবিরের রঙে রাঙিয়ে দেয়।

সেই দিনটি শান্তিনিকেতনে যেন এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যেন এই দিনের সব আনন্দ লুকিয়ে থাকে শান্তিনিকেতনের কোনায় কোনায়। এবং সন্ধ্যেবেলা দোল পূর্ণিমাকে ঘিরে গৌরপ্রাঙ্গণে চলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের পালা।

  • কলকাতার মল্লিক বাড়িতে দোল পূর্ণিমা উৎসব পালন (Dole Purnima festival celebrate at the Mallick house in Kolkata)

কলকাতার মল্লিক বাড়িতেও দোল উৎসব বিশেষভাবে পালন করা হয়। সেখানে আগের প্রথা অনুযায়ী আজও শ্রীমতী ও গোপীচাঁদ বল্লভের এবং রাধাকান্তের পুজো করা হয়। যদিও আজ কোনোমতে নিয়মরক্ষা হয়। তবে আগে মল্লিক পরিবারে এই দিনটি বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হত।

আরও পড়ুন >> বড়দিনের শুভেচ্ছা তিলত্তমা কলকাতায় শুভ বড়দিন উদযাপন

বৃন্দাবনের দোল উৎসব (Vrindavan Dol festival)

বৃন্দাবনের দোল উৎসবঃ

মথুরা, নন্দগাঁও, বৃন্দাবন, বারসানা ৪০ দিনের জন্য দোল উদযাপন করা হয়। ব্রিজ ধামের প্রত্যেকটি স্থানে দোল খেলার স্বাদ ভিন্ন, তবে বারসান হোলি একেবারেই আলাদা যাকে বলা হয় লাথ মার হোলি। লথ মার হোলি বা দোলের পিছনে কারণ বিশেষ আকর্ষণীয়। সেখানকার লোকজনদের মতে কৃষ্ণ নন্দগাঁও থেকে বারসানা পর্যন্ত রাঁধার সঙ্গে হোলি খেলতে আসতেন এবং তাদেরকে জ্বালাতেন। বারসানার নারীরা লাঠি দিয়ে কৃষ্ণ এবং তার বন্ধুদের মজা করে আঘাত করতেন। তাই বারসানার মানুষরাও একই ঐতিহ্য অনুসরণ করে আসছে।

  • নন্দগাঁওতে হোলি  উৎসব (Holi festival in Nandgaon)

নন্দগাঁওতে হোলি  উৎসব

একইভাবে নন্দগাঁওতে হোলি খেলা হয়, যেখানে বারসানা পুরুষেরা নন্দগাঁও আসে সেখানকার মহিলাদের সঙ্গে হোলি খেলতে। লাথ মার হোলি শুধুমাত্র নন্দগাঁও এবং বারানাসাতেই উদযাপন করা হয়। লাথ মার হোলিতে বারসানা এবং নন্দগাঁও ছাড়া বাইরের কেউ অংশগ্রহণ করার অনুমতি নেই।

আরও পড়ুন >> নতুন বছরের শুভেচ্ছা বার্তা ম্যাসেজ ২০২৪

  • বৃন্দাবনে বাঁকে বিহারী মন্দিরে হোলি  উৎসব (Banke Behari temple Holi festival in Vrindavan)

বৃন্দাবনে বাঁকে বিহারী মন্দিরে হোলি  উৎসব

অন্যদিকে বৃন্দাবনে বাঁকে বিহারী মন্দিরে বাইরের লোকেরা আনন্দের সহিত হোলি উদযাপন করতে পারে। বৃন্দাবনে হোলি গুলালের সঙ্গে খেলা হয়। বৃন্দাবনে বাঁকে বিহারী মন্দিরে রাস্তার সামনে গেলেই দেখা পাওয়া যাবে হাজার হাজার বিদেশি মানুষের ঢল। দেখতে পাবেন আবিরে রাঙা রঙিন মানুষ। সেখানে এমন কেউ নেই যে হোলি উৎসব পালন করে না।

সেখানকার মানুষরা আবির ভর্তি প্যাকেট হাতে নিয়ে রাঁধে রাঁধে বলে আবির ছড়িয়ে দেয়। মন্দিরে ভেতরে প্রবেশ করার সময় বালতি এবং পিচকারি দিয়ে মানুষের জামা কাপড় রঙিন করে দেয়। সেই মন্দিরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি পাবেন। ভিতরে প্রভু কৃষ্ণ মূর্তিকে ঘিরে খেলা হচ্ছে আবির এবং প্রচুর মানুষের উপস্থিতি সঙ্গে রাধে রাধে গর্জন। যেন এক অদ্ভুত পরিবেশের মেলবন্ধন।

Back To Top

  • মথুরাথে হোলি  উৎসব (Holi Festival in Mathura)

মথুরাথে হোলি  উৎসব

মথুরাথে ধুমধাম করে হোলি পালন করা হয়, তার পিছনে আছে এক ইতিহাস। বলা হয় শ্রীকৃষ্ণ তখন রাধার গায়ের রঙ দেখে ঈর্ষা করত এবং প্রায় তার মার কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাতেন যে তার এরকম গায়ের রঙ কেন? শুধুমাত্র গায়ের রঙে সমতা আনার জন্য শ্রীকৃষ্ণ রাধার গায়ে রঙ ছুঁড়ে দিয়েছিল।

নন্দগাও থেকে কৃষ্ণা এবং তার বন্ধুরা এসে রাধা এবং রাধার সখিদের রঙ ছুঁড়ে দিত। এবং বদলা দরুন তারাও রঙ নিয়ে ছুড়ত। সেই থেকে এখনও মথুরাতে এইভাবেই হোলি খেলা হয়ে থাকে। এবং তার সাথে লাঠি নিয়ে নাচগান ও হয়।

রাধা কৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে আজও মথুরাতে হোলি উৎসব মানানো হয়। সাতদিন আগে থেকে এই উৎসব পালিত হয়, এবং শেষ দিন অবধি চলে।

আরও পড়ুন >> মহালয়ায় তর্পণ করতে কি কি প্রয়োজন এবং কীভাবে করবেন

বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হোলি উৎসব পালন হয়। তাই নয় দেশের বাইরে বিদেশিদের মধ্যেও এর প্রচলন দেখা যায়। দোল পূর্ণিমা দিন হোলির রঙে সবাই নিজেদের রাঙ্গিয়ে তলে, সমস্ত বিভেদ ভুলে এক হয়ে যায়। আমাদের কলকাতাতেও মহা ধুমধাম এর সাথে পালিত হয়।

ছোট থেকে শুরু করে বড়, সবাই রঙর এর উৎসবে মেতে ওঠে এবং রঙ খেলার পর মিষ্টি মুখ করে এই আনন্দের সমাপ্তি ঘটে। আশা করব দোল পূর্ণিমার এই নিবন্ধনটি আপনাদের ভালো লাগবে। আরও ভালো ভালো তথ্য পেতে আমাদের পেজটি সঙ্গে যুক্ত থাকবেন।

সারকথাঃ

দোল পূর্ণিমা কথার অর্থ ভেদাভেদ ভুলে ভালোবেসে একসূত্রে বেঁধে রাখা।

Frequently asked question

প্রঃ দোল পূর্ণিমা কি বিদেশেও পালন করা হয়?

উঃ বিদেশে অনেক স্থানেই পালন হয়, তবে তা হোলি নামে পরিচিত।

প্রঃ মথুরায় দোল উৎসব কতদিন উদযাপন হয়?

উঃ মথুরায় দোল উৎসব টানা সাতদিন ধরে পালন হয়।

প্রঃ  নন্দগাঁও এবং বারসানা কি হোলিতে বাইরের কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে না?

উঃ বারসানা মানুষরাই নন্দগাঁও এসে হোলি খেলে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী। তাই বাইরের কারো সেই খেলায় অংশগ্রহণ করার অনুমতি নেই।

2 Comments

Leave A Reply

Please enter your comment!
Please enter your name here