বছরের পর বছর ধরে মানুষ আধ্যাত্মিকতা এবং হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্যের টানে ছুটে যাচ্ছেন কেদারনাথে। চারধাম যাত্রা শুরু হয় এই কেদারনাথ ধাম দিয়েই। এই যাত্রা একেবারেই সহজসাধ্য নয়, বরং বেশ কঠিন।
২০১৩ সালের ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে পর্যন্ত গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথের দূরত্ব ছিল ১৪ কিলোমিটারের মতো। কিন্তু সেই রাস্তা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার নতুন করে যে পথ তৈরি করা হয়েছে, তাতে দূরত্ব বেড়ে হয়েছে প্রায় ২২ কিলোমিটার। রাস্তার বেশিরভাগ অংশই চড়াই। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থাকা সত্ত্বেও কেদার বাবার দর্শনের আকর্ষণ আজও মানুষের মনে।
অনেকেই আছেন যারা চারধাম যাত্রা না করে শুধু কেদারনাথ বদ্রীনাথ ঘুরেই চলে আসেন। কেউ আবার কেদারনাথ যাত্রা সেরেই ফিরে আসেন। তবে কেদারনাথ যাত্রায় এমনার কিছু দর্শনীয় স্থান আছে যা ঘুরে না দেখলে আপনার যাত্রাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই আজকের আলোচনায় রইল কেদারনাথ ভ্রমণের খুঁটিনাটি।
1. বাসুকি তাল
কেদারনাথের কাছেই বাসুকি তাল। সেখানে অগাস্ট মাস নাগাদ গেলে ব্রহ্মকমল ফুটে থাকতে দেখা যেতে পারে। অক্টোবরে গেলে আবার গোটা জলাশয়টাই বরফে ঢাকা দেখা যাবে।
2. রুদ্রনাথ মন্দির
পঞ্চ কেদার যাত্রার মধ্যেই পরে এই রুদ্রনাথ মন্দির, যা পাণ্ডবদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হয়। পুরাণ অনুযায়ী, এই মন্দিরটি সেই স্থান যেখানে ভগবান শিবের মাথা ষাঁড়ের আকারে আবির্ভূত হয়েছিল। আর মহিষরূপী শিবের মস্তক অংশটি এখানে পূজিত হয়।
3. সোনপ্রয়াগ
গৌরীকুন্ড থেকে ৪ কিমি, কেদারনাথ থেকে ১৮ কিমি এবং রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ৭০ কিমি দূরে, সোনপ্রয়াগ উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম। প্রয়াগ মানে সঙ্গম এবং সোনপ্রয়াগ দুটি পবিত্র নদী বাসুকি এবং মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। আর এই নদীতে স্নান করলে মানুষের সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় বলেই সকলের বিশ্বাস।
4. ভৈরবনাথ মন্দির
কেদারনাথ মন্দির থেকে ১ কিমি দুরেই রয়েছে দেবাদিদেব মহাদেবের এই সুন্দর মন্দির। বলা হয়, স্বয়ং ভৈরবনাথই কেদারনাথ মন্দিরের রক্ষক। তাই কেদারনাথ ট্রেকে অনেকেই এই মন্দির পরিদর্শন করতে যান।
5. গৌরী কুন্ড
পুরাণ অনুযায়ী, দেবী পার্বতী ভগবান শিবের সাথে বিবাহের জন্য বছরের পর বছর কঠোর তপ বা ধ্যান করেছিলেন। গাড়ওয়াল হিমালয়ে অবস্থিত গৌরীকুন্ড হল সেই জায়গা যেখানে তিনি তপ করেছিলেন।
6. শঙ্করাচার্য সমাধি
শঙ্করাচার্যের সমাধিটি কেদারনাথ মন্দিরের ঠিক পিছনেই রয়েছে। আদি শঙ্করাচার্য ছিলেন একজন ধর্মতত্ত্ববিদ এবং একজন মহান চিন্তাবিদ যিনি অদ্বৈত বেদান্তের তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বহুদূরে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তিনিই অষ্টম শতাব্দীতে কেদারনাথ মন্দিরের সংস্কার করেছিলেন এবং আরও চারটি মঠ স্থাপন করেছিলেন। শেষে কেদারনাথ এসে তিনি তার যাত্রা শেষ করেছিলেন।
7. ত্রিযুগিনারায়ণ
ত্রিযুগীনারায়ণ মন্দিরকে ঘিরেই ছোট একটা গ্রাম, যে কেদারনাথ মন্দিরের একদম কাছেই। যেখানে আজও জ্বলছে যজ্ঞের অগ্নিকুন্ড। পুরাণ মতে, নারায়ণকে সাক্ষী রেখে এই অগ্নিকুন্ডে বিয়ে হয়েছিল হর-পার্বতীর। পৌরহিত্য করেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। আর সেই অখণ্ডধুনির শিখা আজও প্রজ্জ্বলিত বলে ভক্তদের বিশ্বাস। আর তাই এই অগ্নিকুন্ডে কাষ্ঠ আহুতি দেওয়ার প্রথাও রয়েছে। মন্দিরের চারপাশে রয়েছে ব্রহ্মাকুন্ড, সরস্বতীকুন্ড, রুদ্রকুন্ড, বিষ্ণুকুন্ড এই চার কুন্ড। চারিদিকে পাহাড়, মাঝে সবুজে ঘেরা পরিবেশে এই মন্দির কেদারনাথ যাত্রার অন্যতম আকর্ষণ।
8. অগস্ত্যমুনি
অগস্ত্যমুনি, উত্তরাখণ্ডের একটি পবিত্র শহর, যা কেদারনাথ থেকে ৬৭ কিলোমিটার দূরে এবং রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মনে করা হয় যে ঋষি অগস্ত্য প্রায় এক বছর ধরে এই স্থানে ধ্যান করেছিলেন। কেদারনাথ দর্শনে অগস্ত্যমুনি আশ্রম অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
9. তুঙ্গনাথ মন্দির
মন্দাকিনী এবং অলকানন্দা নদীর উপত্যকার উপর অবস্থিত এই তুঙ্গনাথ মন্দির। পঞ্চ কেদারের তৃতীয় কেদার এটি। মন্দিরের সামনের বাঁধানো অংশের এক পাশে আছেন পঞ্চ ঈশ্বরী মাতা, ভগবান বিষ্ণু, গৌরীশঙ্কর পিতৃদেব,ভৈরবনাথ।গর্ভমন্দিরের ভেতর রয়েছে লিঙ্গ মূর্তি এবং মূর্তির পিছনে আছে শঙ্করাচার্যের তৈলচিত্র, বাঁদিকে আছে কালভৈরব এবং ডান দিকে আছে ঋষি বেদব্যাস। মন্দিরের সামনে রয়েছে নন্দী মূর্তি।
10. চোরাবাড়ি লেক
হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই সুন্দর লেকটি গান্ধী সরোবর নামেও পরিচিত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৯০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই হ্রদটি তুষারাবৃত হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত। কেদারনাথ ধাম থেকে মাত্র ৩ কিমি দুরত্বেই রয়েছে এই লেক। তাই কেদারনাথ দর্শনে এসে অনেক পর্যটকই এই লেকে বেরাতে আসেন।
11. গুপ্তকাশী
উখিমঠ থেকে ১৩ কিমি দূরে, কেদারনাথ থেকে ৪৬ কিমি, গৌরীকুন্ড থেকে ৩২ কিমি এবং রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ৪৫ কিমি দূরে গুপ্তকাশী হল রুদ্রপ্রয়াগ জেলার গাড়ওয়াল হিমালয়ের মন্দাকিনী নদীর তীরে কেদারনাথ যাওয়ার পথে অবস্থিত একটি ছোট শহর।
পুরাণ অনুযায়ী, মহাভারতের যুদ্ধের পরে, পাণ্ডবরা ভগবান শিবের সাথে দেখা করতে এবং তার আশীর্বাদ চাইতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহাদেব তাদের সাথে দেখা করতে চাননি এবং প্রথমে নিজেকে গুপ্তকাশীতে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
শুধু তাই নয় এখানে রয়েছে বিশ্বনাথ মন্দির এবং অর্ধনারেশ্বর মন্দিরের মতো বহু প্রাচীন মন্দির।
12. চন্দ্রশীলা
কেদারনাথের দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে চন্দ্রশীলা চূড়া অন্যতম, এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০০ মিটার উপরে অবস্থিত। এই স্থানটিকে বিশ্বাস করা হয় যেখানে ভগবান রাম রাবণকে বধ করার পর শিবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। রাম রাবণকে বধ করে রাক্ষস বংশের অবসান ঘটিয়ে এই পবিত্র ভূমিতে ধ্যান করে তার পাপ মোচন করতে চেয়েছিলেন। এখান থেকে দেখা যাবে গাড়োয়াল ও কুমায়ুঁর মাঝে বহু শৃঙ্গমালা। দেখা যাবে নন্দাদেবী, চৌখাম্বা, কেদারনাথ, ত্রিশূল সহ বহু পর্বতচূড়া। চন্দ্রশীলার অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য কেদারনাথ যাত্রার অন্যতম আকর্ষণ।
কেদারনাথ ধামের পাশাপাশি এখানে আর কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা এই স্থানকে আরও বিচিত্র করে তোলে। সেইসাথে কেদারনাথ পর্বত তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণের অন্যতম জায়গা। যেখানে বরফে ঢাকা পাহাড় আর নীল আকাশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। কেদারনাথ মন্দির আসলে পঞ্চকেদারের অংশ। তাই এই মন্দির ছাড়াও রয়েছে আরও চারটি মন্দির- তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, মধ্যমহেশ্বর এবং কল্পেশ্বর।