মহাকালেশ্বর মন্দির । তীর্থস্থান । মধ্যপ্রদেশ

মহাকালেশ্বর মন্দির

ভারতে ভগবান শিবের ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একটি হল এই মহাকালেশ্বর মন্দির। শিপ্রা নদীর তীরে অবস্থিত উজ্জয়িনী শহরের প্রাণকেন্দ্র এই মন্দিরকে দেশের অন্যতম পবিত্র মন্দির বলে গণ্য করা হয়। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গটিকে স্বয়ম্ভু বা শিবের সাক্ষাৎ-মূর্তি বলে মনে করা হয়। চতুর্থ শতাব্দীতে কালিদাস রচিত ‘মেঘদূতম’-এও এই মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে।

মহাকালেশ্বর মন্দিরের শিবলিঙ্গই একমাত্র জ্যোর্তিলিঙ্গ, যার মুখ দক্ষিণ দিকে। বাকি এগারোটি জ্যোতির্লিঙ্গই পূর্বমুখী। সেই কারণে এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ ‘দক্ষিণমুখী’ নামেও পরিচিত। শিবলিঙ্গটি দক্ষিণ দিকে মুখ করে রয়েছে বলে, মনে করা হয় দক্ষিণ হল মৃত্যুর দিক। আর তাই কালের অধিশ্বর রুপে মহাকালেশ্বর এই মন্দিরে বিরাজমান।

মহাকাল মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ ‘ভস্ম আরতি’। বহু পুণ্যার্থীরা কেবল এই আরতি দেখার জন্যই অনেক দূর থেকে এই মন্দিরে আসেন। আজকের আর্টিকেলে রইল মহাকালেশ্বর মন্দির যাত্রা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য।

মহাকালেশ্বর মন্দিরে কিভাবে যাবেন?

কলকাতা থেকে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরটি। যার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ। আর মহাকালের দর্শন পেতেই লক্ষ লক্ষ শিবভক্তের সমাগম হয় এই মন্দিরে। আপনিও যদি মহাকালেশ্বর মন্দিরে যেতে চান তাহলে আপনাদের সুবিধামত ফ্লাইট, ট্রেন কিংবা সড়কপথে সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন উজ্জয়িনী শহরে। সেক্ষেত্রে আপনি যদি কলকাতা নিবাসী হয়ে থাকেন তাহলে-

বিমানপথে- কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি পৌঁছে যান ইন্দোর বিমান বন্দরে। এরপর ইন্দোর এয়ারপোর্ট থেকে যেকোন গাড়িতে কিংবা বাসে পৌঁছে যেতে পারেন উজ্জয়িনী। আর সেখানেই দর্শন করে নিন মহাকাল জ্যোতির্লিঙ্গের।

ট্রেনপথে- ট্রেন পথে যেতে চাইলে সরাসরি উজ্জয়িনী জংশনে নামুন, এরপর স্টেশন থেকে (২ কিলোমিটার দুরত্ব) যেকোন গাড়িতে পৌঁছে যান মহাকালেশ্বর মন্দিরে।

সড়কপথে- উজ্জয়িনী শহরটি বাকি অন্যান্য শহররে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সাথে খুব ভালোভাবে সংযুক্ত। তাই নিজস্ব গাড়িতে হোক বা বাসে, যেকোন ভাবেই পৌঁছে যেতে পারেন মহাকালের মন্দিরে।

মহাকালেশ্বর মন্দিরের কাছে থাকার সেরা জায়গা । হোটেল 

সনাতন ধর্মের বিশ্বাস, শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একটি রয়েছে এই মহাকালেশ্বর মন্দিরে।

প্রতি বছরই মহাকালকে দর্শন করতে লক্ষ লক্ষ শিবভক্ত মানুষ উজ্জয়িনী শহরে আসেন। সেইসাথে এই শহরের আরও অন্যান্য দর্শনীয় স্থানও ঘুরে দেখার মত। তবে এই শহরে ঘুরতে এসে পর্যটকদের থাকার জন্য বেস্ট কিছু হোটেলের সন্ধান দিতে পারি আপনাদের।

সেক্ষেত্রে হোটেল অথর্ভ, হোটেল ইম্পেরিয়াল গ্র্যান্ড, হোটেল সত্যম, হোটেল রয়্যাল প্যালেস ইত্যাদি হোটেল গুলোকে বেছে নিতে পারেন। হোটেল গুলোর দুরত্ব মন্দির থেকে কাছাকাছি হওয়ায় হোটেল থেকে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে মহাকালের মন্দিরে।

মহাকালেশ্বর মন্দির যাওয়ার সেরা সময়

হিন্দু দেবতা শিবের অনেক রূপের মধ্যে একটি রূপ মহাকাল। পুরাণ অনুযায়ী, উজ্জয়িনী শহরে অবস্থিত মহাকালেশ্বর মন্দিরে শিবের এই রূপ সময় ও মৃত্যুর দেবতা। মনে করা হয়, এই জ্যোতির্লিঙ্গই শিবের সবচেয়ে পবিত্র আধার।

অক্টোবর থেকে মার্চ মাস হল উজ্জয়িনী শহরটি ভ্রমণের সেরা মাস কারণ এই সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে। তাছারা গ্রীষ্মকালে এই শহরটি তুলনামূলকভাবে উত্তপ্ত এবং মধ্যপ্রদেশের অন্যান্য অংশের মতো তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায়। অন্যদিকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা থাকায় ভারী থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও থেকে যায়।

তাই শীত কালেই এই মন্দির পরিদর্শনের সেরা সময়। বিশেষ করে মার্চ মাসে যখন প্রতি ১২ বছরে একবার কুম্ভ মেলা শুরু হয়। কারণ এই সময়তেই পুরো মন্দিরটিকে সুন্দর করে সাজানো হয়। লক্ষ লক্ষ শিবভক্তের সমাগম দেখা যায় এই সময়ে।

মহাকালেশ্বর মন্দিরে পূজার সময়

ভোর ৪ টে থেকে ৬ টা পর্যন্ত চলে এই মন্দিরের সবচেয়ে বিখ্যাত আরতি ভস্ম আরতি। সারা বিশ্ব থেকে ভক্তরা এই পবিত্র অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে সমবেত হয়। এরপরেই সকাল ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত চলে রুদ্রাভিষেক পূজা। এই সময় বৈদিক মন্ত্রের সাথে সাথে দুধ, দই, মধু, ঘি এবং জল দ্বারা মহাকাল কে স্নান করানো হয়। এরপরেই শুরু হয় দেবাদিবেদ মহাদেবের শ্রিংগার দর্শন। যা চলে সকাল ৭ টা থেকে প্রায় ১০.৩০ টা পর্যন্ত। এই সময় মহাকাল কে বিভিন্ন অলঙ্কার, ফুল এবং পোশাক দিয়ে রাজার বেশে সাজানো হয়।

এরপর দুপুর ১২ টার মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায়, মহাদেবের পঞ্চামৃত অভিষেক। পঞ্চামৃত অভিষেকে, শিব লিঙ্গকে পাঁচটি পবিত্র তরল: দুধ, দই, মধু, ঘি এবং চিনির মিশ্রণ দিয়ে স্নান করানো হয়। সন্ধ্যায় সন্ধ্যা আরতি দেখার জন্য বহু ভক্তের আগমন হয় এই মন্দিরে। যা সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টার মধ্যে সম্পন্ন হয়।

সবশেষে রাতে ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত চলে রাতের পুজা এই সময়তেও ভক্তরা মহাদেবের আশীর্বাদ নিতে মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। তবে পরিবর্তনশীল ঋতু এবং বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য মন্দিরের সময় এবং পূজার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। মহাকালেশ্বর মন্দির সারা বছর ধরে বিভিন্ন উত্সব এবং বিশেষ অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। মহা শিবরাত্রি, শ্রাবন মাস, নাগ পঞ্চমী, কার্তিক পূর্ণিমার মত বিশেষ অনুষ্ঠান গুলিতে মন্দির সহ মহাকালকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়।

জ্যোতির্লিঙ্গের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে বিশাল রৌপ্য নির্মিত ত্রিশূল ও ডমরু। মন্দিরের উত্তরে অবস্থান করছেন শ্বেতপাথরের দ্বারা নির্মিত দেবী পার্বতীর মূর্তি। পশ্চিম দিকে রয়েছেন শ্রীমান গণপতি আর পূর্বদিকে রয়েছেন শ্রী কার্তিকেয়।

মহাকালেশ্বর মন্দিরের আশেপাশে ঘোরার জায়গা

মহাকালেশ্বর মন্দিরের পর পর্যটকদের আরও একটি আকর্ষণের জায়গা হল কাল ভৈরব মন্দির। এই কালভৈরব হলেন তন্ত্র সাধনার প্রধান দেবতা। পাশাপাশি দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে উজ্জয়িনীর রাম ঘাট পরিদর্শন। উজ্জয়িনী শহরের ঐতিহাসিক তাত্পর্য সম্পর্কে জানতে ঘুরে আসতে পারেন কালিদেহ প্রাসাদে।

উজ্জয়িনী শ্রীমহাকালেশ্বর মন্দিরের কাছেই রয়েছে সন্দীপনি মুনির আশ্রম। শহর থেকে দূরে সুন্দর গাছপালায় ঘেরা পরিবেশের মধ্যে অবস্থিত এই তপোবন। এই আশ্রমেই দাদা বলরাম আর বন্ধু সুদামাকে নিয়ে শাস্ত্র ও শস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।

উজ্জয়িনীর পথে পথে লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস। মহাকাল মন্দিরের একটু দূরেই অবস্থিত হরসিদ্ধি মন্দির। এই মন্দিরটি একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম। কথিত আছে এখানে দেবীর কনুই পতিত হয়েছিল। হরসিদ্ধি মন্দিরের নিকটেই রয়েছে বিক্রমাদিত্য মন্দির।

উজ্জয়িনীর আরো একটি দর্শনীয় স্থান রাজা ভর্তৃহরির গুহা। এখানে রাজা ভর্তৃহরির কালোপাথরে নির্মিত ছোট মূর্তি রয়েছে । এছাড়াও নাথ সম্প্রদায়ের গোরক্ষনাথ ও গোপীচন্দ্রের মূর্তিও রয়েছে এখানে। মহাকালেশ্বর এর অবস্থানের জন্যই সনাতনধর্মাবলম্বীদের কাছে এই শহর এক পবিত্র তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে।

এছাড়াও উজ্জয়িনীতে প্রতি ১২ বছর অন্তর কুম্ভমেলার আয়োজন করা হয়। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী কুম্ভমেলার পবিত্র তিথিতে স্থান করে পুন্যার্থীরা পুন্য অর্জন করতে যায়।

মহাকালেশ্বর যাত্রায় সেরা খাবার  

মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরটি যেমন বৈচিত্রপুর্ন তেমনি এখানকার খাবার গুলিও বেশ সুস্বাদু। তাই এই শহরে ঘুরতে এসে এখানকার বেস্ট খাবারের আইটেম গুলি চেখে দেখতে ভুলবেন না। উজ্জয়িনী সফরে এসে সবার প্রথমে ট্রাই করতে পারেন ভুট্টে কা কিস, ডাল বাফলা, ইন্দোরি নামকিন, পোহা’র মত বিশেষ কিছু খাবার। এখানেই শেষ নয়, রয়েছে ডেজার্ট হিসাবে কুলফি, মাওয়া বাটি’র মত সুন্দর সুন্দর টেস্টি খাবারের আইটেম।

তবে এইসব খাবার গুলি চেখে দেখতে উজ্জয়িনী শহরের সেরা কিছু রেস্তোরাঁ বেছে নিতে পারেন। তার মধ্যে রয়েছে ঝাড়োখা রেস্টুরেন্ট, সুদামা রেস্টুরেন্ট, ইম্পেরিয়াল রেস্তোরাঁ, মহাকালেশ্বর মার্গের কাছে ভোলা গুরু অ্যান্ড সন্স, ডমরুওয়ালা রেস্তোরাঁতেও যেতে পারেন।

সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন ও উত্তরঃ

প্রঃ  মহাকালেশ্বর মন্দিরটি কোথায় অবস্থিত? 

উঃ ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের প্রাচীন শহর উজ্জয়িনী তে অবস্থিত মহাকালেশ্বর মন্দির।

প্রঃ মহাকালেশ্বর মন্দির কে নির্মাণ করেন?

উঃ মন্দিরটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে উজ্জয়নের প্রাক্তন রাজা চাঁদপ্রদ্যোতের পুত্র কুমারসেন দ্বারা নির্মিত বলে মনে করা হয়।

প্রঃ মহাকালেশ্বর মন্দিরটি কিসের জন্য বিখ্যাত?

উঃ  ১৮টি মহাশক্তি পীঠমগুলির মধ্যে একটি হল এই মহাকালেশ্বর মন্দির। চতুর্থ শতাব্দীতে কালিদাস রচিত ‘মেঘদূতম’-এও এই মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে।

প্রঃ মহাকালেশ্বর মন্দিরে জ্যোতির্লিঙ্গ দক্ষিণমুখী কেন? 

উঃ মহাকালেশ্বর মন্দিরের শিবলিঙ্গই একমাত্র জ্যোর্তিলিঙ্গ, যার মুখ দক্ষিণ দিকে। বাকি এগারোটি জ্যোতির্লিঙ্গই পূর্বমুখী। সেই কারণে এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ ‘দক্ষিণমুখী’ নামেও পরিচিত। শিবলিঙ্গটি দক্ষিণ দিকে মুখ করে রয়েছে বলে, মনে করা হয় দক্ষিণ হল মৃত্যুর দিক। আর তাই কালের অধিশ্বর রুপে মহাকালেশ্বর এই মন্দিরে বিরাজমান।

প্রঃ  মহাকালেশ্বর মন্দিরের বয়স কত?

উঃ  খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে মন্দিরটি রাজা চাঁদপ্রদ্যোতের পুত্র কুমারসেন দ্বারা নির্মিত হলেও খ্রিস্টীয় 12 শতকে রাজা উদয়াদিত্য এবং রাজা নরবর্মণের অধীনে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। 

প্রঃ উজ্জয়িনী কোন রাজ্যের রাজধানী? 

উঃ  অবন্তী রাজ্যের রাজধানী।