হাওয়া ভালো নয়, বসন্ত এসে গেছে । চারিদিকে বাড়ছে চিকেন পক্স বা জলবসন্ত। তাই এই সময় সাবধানতা বেশি জরুরী। চিকেন পক্স, হাম এই রোগগুলির সঙ্গে আমারা বহুদিন ধরেই পরিচিত। অনেকে আবার চিকেন পক্স হলে কুসংস্কার মেনে থাকেন। চিকিৎসা করান না, মাছ-মাংস খান না, এতে আপনারা নিজদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছেন।
চিকেন পক্স-হামের সতর্কতা নিয়ে শুরু করার আগেই বলে রাখি, আগেকার দিনের মানুষরা কিন্তু অসুখ হলে জড়িবুটি বা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠতেন, তাদের তেমন ডাক্তারের ঔষধের প্রয়োজন হত না। কারণ কি জানেন? সেকালের মানুষ প্রচুর পরিশ্রম করতেন, আর তাদের সময় সমস্ত কিছু খাঁটি ছিল। তাই তাদের রোগ-প্রতিরোধের ক্ষমতা আমাদের দিয়ে অনেক বেশি ছিল। আর এখনকার দিনে আমাদের চারপাশে ভেজাল, এমনকি আমাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে সব। তাই এযুগের মানুষের পরিশ্রম তুলনামূলকভাবে কম এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কম। তাই আমাদের যেকোনো রোগ থেকে সুস্থ হতে ডাক্তারের ঔষধ খেতে হয়। তাই আপনি যদি ভেবে থাকেন এখন চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়ে আগেকার প্রচলিত কুসংস্কার মেনে চলবেন, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে আপনার জীবনে বিপদ আনতে পারে।
চিকেন পক্স নিয়ে ভুল ধারণাঃ
আগেকারদিনে মানুষ চিকেন পক্স হলে বলত ‘মায়ের দয়া’। শীতলা দেবীর দেওয়া কোনো রোগ। অনেকেই সেই বিশ্বাস নিয়ে আজও অনেক ভুল করে থাকেন এই রোগে আক্রান্ত হলে। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে, চিকেন পক্স কোনও দেবীর দেওয়া রোগ নয়, এটি একটি স্বাভাবিক রোগ। ভেরিসেলা-জস্টার ভাইরাসের জন্য এই রোগ হয়। এই রোগ অত্যন্ত ছোঁয়াচে। কোনও আক্রান্ত ব্যক্তির সংক্রমণ থেকেই এই রোগ ছড়ায়।
প্রথমে জলগুটি ওঠা শুরু হয় পিঠে, তারপর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি জ্বর-মাথাব্যাথা হয়ে থাকে।
চিকেন পক্স হলে মাছ-মাংস খাওয়া যায়?
আজও অনেকের মতে চিকেন পক্স বা জলবসন্ত শীতলা মায়ের দেওয়া রোগ। তাই ঘরে আমিষ প্রবেশ করানো যাবে না। নিরামিষ খেতে হবে। তাই রোগীকে একেবারেই মাছ-মাংস দেওয়া যাবে না। এটা কি আপনারাও ধারণা?
একেবারেই ভুল। আবারও বলে রাখি, এখনকার রোগব্যাধি কিন্তু অনেক শক্তিশালী। আগেরকার চিকেন পক্সের সঙ্গে এখনকার পক্সের অনেকটাই ফারাক। তাই ভুলেও আগেকার দাদু-দিদিমার ধারণা মেনে চলবেন না। বরং চিকেন পক্স হলে ডাক্তারের ঔষধ নিন।
চিকিৎসকদের মতে, পক্স হলে শরীর অনেক দুর্বল হয়ে পরে তাই সুস্থ হতে এই সময় রোগীদের বেশি করে প্রোটিন খাওয়াতে হয়। ডিম-মাছ-মাংস অবশ্যই খাওয়াতে হবে। অনেক রোগীর আবার এই সময় মাছ-মাংসে বমি পায়, সেটা আলাদা। কিন্তু যারা খেতে পারছেন তাদের সুস্থ হতে অবশ্যই খাওয়াতে হবে। না, হলে তাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা আরও কমে যাবে। বরং পরবর্তীকালে শরীরে আরও রোগব্যাধি বাসা বাঁধবে। এতে আরও বিপদ হবে।
চিকেন পক্স হলে করনীয়ঃ
প্যারাসিটামলঃ যদি চিকেন পক্স আক্রান্ত রোগীর ১০০-এর বেশি জ্বর আসে তাহলে অবশ্যই তাঁকে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে।
তরল খাবারঃ আগেরকার দিনে বলা হত, যেহেতু এটা দেবীর দেওয়া রোগ, তাই নিরামিষ খেতে হবে, ডাবের জল খেতে হবে। তবে এই ধারণা ভুল। দেবীর জন্য নয়, বরং এই রোগ হলে শরীরে জলের অভাব দেখা দেয়। তাই বেশি করে তরল খাবার খাওয়ানোর কথা বলা হয়। ডাবের জল যেহেতু শরীরের জন্য ভালো। তাই ডাবের জল খেতে হবে শরীর ঠাণ্ডা রাখতে। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে।
চিকেন পক্স হলে খাবার রুচি চলে যায়। পাশাপাশি শক্ত খাবার খেলে হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই রোগীকে তরল খাবার খাওয়ানোর কথা বলে থাকেন ডাক্তাররা।
ঔষধঃ অনেকেই ভেবে থাকেন রোগীকে আলাদা রেখে, ধূপদীপ জ্বালিয়ে, নিরামিষ খাইয়ে রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়। এই ধারণা নিয়ে থাকা ভুল। এখনকার রোগ সারাতে অবশ্যই ডাক্তারের ঔষধ জরুরী। তাই ডাক্তার দেখিয়ে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করুন।
প্রোটিনঃ চিকেনপক্স হলে মাছ, মাংস খাওয়া যায় না, এটা একটি কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং চিকিৎসকদের মতে এই সময় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই এই সময় রোগীর শরীরে প্রচুর প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। এর জন্যই বেশি করে মাছ-মাংস খাওয়ানো উচিত।
আলো-বাতাসঃ যেহেতু এটি একটি ভাইরাস সংক্রমিত রোগ, তাই রোগীকে আলাদা রাখতে হবে। যাতে তাঁর থেকে অন্য কারো দেহে ছড়িয়ে না পড়ে। ভাইরাস দমনে আলো-বাতাস প্রয়োজন হয়। তাই ঘরে যাতে দিনের বেলা আলো-বাতাস খেলে নজর রাখতে হবে।
আগেকার দিনে অনেকেই বলতেন রোগী যেই ঘরে থাকবে সেই জানলা-দরজা খুলে রাখতে হয়, কারণ শীতলা মা এসে রোগীকে ঝেড়ে দিয়ে যান। এরকম ধরনের কথা আমারা অনেকের মুখে শুনে থাকি কিন্তু এই ধারণা একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। ভাইরাস জনিত কারণেই ঘরে আলো-বাতাস ঢোকার জন্য দরজা-জানালা খুলে রাখতে বলা হয়।
ক্যালামাইন লোশনঃ চুলকানি কমাতে ক্যালামাইন লোশন লাগান, আরাম পাবেন। তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেবেন। চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ খান।
সুতির জামাকাপড়ঃ চিকেন পক্স হলে সুতির জামা-কাপড় পরা কুসংস্কার নয়। যেহেতু জলবসন্ত আক্রান্ত রোগীর দেহে সারা গায়ে গুটি থাকে। তাই ভারী পোশাক পড়ালে ঘর্ষণের আশঙ্কা থাকে। তাই সুতির পোশাক পড়ানো উচিত এতে রোগীর আরাম লাগে।
চিকেন পক্সে সতর্কতাঃ
মেথির জলঃ পক্স হলে অনেকে বলে থাকেন মেথির জল খাওয়ার কথা। তবে হোমিওপ্যাথি কিছু চিকিৎসকেরা বলে থাকেন মেথি জল একদম নয়। যদিও এর কারণ জানা নেই। তাই খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
তেল-মশলা নয়ঃ রোগীর রান্নায় বেশি তেল-মশলা দেওয়া চলবে না। পাতলা খাবার খেতে হবে।
ছোটদের চিকেন পক্সের টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা৷ বড়রাও এই টিকা নিতে পারেন৷ চিকেন পক্সে আক্রান্ত হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ প্রয়োগ করলে বাড়াবাড়ি হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
চিকেন পক্সে কুসংস্কার নয়। আপনার ভক্তি থাকুক কিন্তু পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলবেন। কারণ এই সাধারণ রোগ অবহেলা করলে নিউমোনিয়ার মতো সমস্যা আসতে পারে।