আট থেকে আশি গোপাল ভাঁড়ের গল্প পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যি দুস্কর। কৃষ্ণনগরের উত্তর দিকে ঘুর্নি নামের এক গ্রামে গোপাল ভাঁড়ের জন্ম। তার আসল নাম গোপাল চন্দ্র প্রামাণিক। গরীব পরিবারে জন্ম হওয়ায় লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। শোনাযায় গোপাল ভাঁড় ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব বুদ্ধিমান ছিলেন। কিন্তু অল্পশিক্ষা আর তার নিজের অসীম বুদ্ধি ও প্রতিভার গুনেই তিনি আজও সকলের মনে রয়ে গেছেন।
একটা সময় গোপাল ভাঁড়ের বুদ্ধি ও রসিকতার কাহিনী লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই কারনেই নদীয়ার সম্রাট মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র লোকমুখে গোপালের রসিকতা ও বুদ্ধির কথা শুনে তাকে রাজসভায় স্থান দিয়েছিলেন। সেই থেকে গোপালের পরিচিতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আজও গোপাল ভাঁড়ের গল্প গুলি আমাদের মন ভাল করে দেয়। তাই সকলের জন্য রইল মজাদার গোপাল ভাঁড়ের গল্প।
Read more: ছোটদের জন্য মজাদার রূপকথা গল্প
গোপাল ভাঁড়ের আলু কেনা
গোপাল একবার হাটে আলু কিনতে গিয়েছিল। সেই পথেই দেখা হল এক বন্ধুর সাথে। গোপালের আলু কিনতে যাওয়ার কথা শুনেই রসিক বন্ধুটি বলল, তুমি যদি আলু বিনে পয়সায় কিনতে পার দশ টাকা পুরষ্কার পাবে। বন্ধুটি রসিকতা করার লোভে গোপালকে একটু উসকে দিল। মনে করেছিল গোপাল পারবে না।
গোপাল বন্ধুকে বললে, ও এই কথা? তুমি আমার সাথে হাটে চল দেখবে, দিব্যি বিনে পয়সায় আলু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরব। কাউকে কোনও পয়সা দিবনা। তা তুমি নিজে চোখেই দেখতে পারবে।
হাটে গিয়ে গোপাল প্রত্যেক আলু বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলে ভাই, আমি যদি তোমার কাছে থেকে পাঁচ সের আলু কিনি, কটা আলু ফাউ দেবে তুমি আমাকে বল? শীতের সময় সেদিন বাজারে আলুর প্রচুর আমদানি। আলুওয়ালারা বললে পাচঁটা করে আলু ফাউ পাবেন পাঁচ সের আলু কিনলে। এর বেশি দিতে পারব না।
গোপাল তখন প্রত্যেক আলুওয়ালার ঝুড়ি থেকে পাঁচটা করে আলু তুলে নিয়ে বলল, এই হাটে কেবল ফাউটা নিলাম, সামনের হাটে তোমাদের সকলের কাছ থেকে পাঁচ সের করে আলু কিনব। সকলেই হ্যা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। গোপাল দিব্যি বিনে পয়সার আলু কিনে বাড়ি ফিরল। বন্ধুকে বাধ্য হয়েই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গোপালকে দশ টাকা পুরষ্কার দিতে হল।
Read more: সফলতার শিক্ষনীয় গল্প যা জীবন বদলে দেবে
গোপাল করল বিয়ের ঘটকালি
গোপাল একবার একটি বিয়ের ঘটকালি করেছিল। মেয়েটি খোঁড়া, ছেলেটি কানা। কনেপক্ষ পাত্র পক্ষ গোপালের মুখের কথায় উপর নির্ভর করেই বিয়ে পাকাপাকি করে ফেলেছিল। কনেপক্ষ জানে না যে বর কানা, আবার পাত্রীপক্ষ জানে না যে মেয়ে খোঁড়া। গোপালের ভীষণ নাম ডাকের জন্য কেউ কাউকে অবিশ্বাস করতে না পেরে বিয়ের সবকাজ গোপালের উপরই ছেড়ে দিয়েছে।
বিয়ে হয়ে যাবার পর পাত্রকক্ষের কর্তা গোপালকে ডেকে বললেন, কনেপক্ষের লোকেরা জানতেই পারেনি যে, বর কানা। বরকে কানা দেখলে কোন বাপই মেয়ে দিত না। এর জন্য আপনার কাছে বেশ কৃতজ্ঞ আমরা। এই বলে পাত্রপক্ষের লোকেরা কিছু পুরষ্কার বাবদ টাকা দিল গোপালকে। তাদেরকে কিছু না বলেই গোপাল তা নিয়ে নিল।
এদিকে কন্যাপক্ষের লোক এল। তারা এসে গোপালকে বলল, মেয়েটি যে খোঁড়া পাত্রপক্ষের লোকেরা জানতেই পারেনি, কি বল গোপাল! এই বলে কন্যাপক্ষের লোকেরা গোপালকে কিছু পুরষ্কার দিল।
দুপক্ষের কাছেই মোটা বকসিস পেয়ে আনন্দে আটখানা গোপাল মনে মনে হাসতে হাসলে বলল, আপনারা মহাশয় ব্যক্তি। তাহলে সব কথা খুলে বলি শুনুন, আপনার মেয়েটি খোঁড়া আর বরও কানা। এতে অবশ্য দুপক্ষের চিন্তা ভাবনা করার কোনও কারণই নেই।
গোপালের কথা শুনে বর পক্ষের আক্কেল গুডুম। বললেন, অ্যাঁ, বলো কি। পাত্রী খোঁড়া? আগে এ কথা আমাদের বলেননি কেন? গোপাল বললে, নইলে মানাবে কেন দাদা? না মানালে আমরাই যে বদনাম। আমি তো কারও কাছে বদনাম শুনতে রাজি নই। এখন আর আপনাদের কারোর কিছু বলার থাকলো না।
Read more: একটি ভালোবাসার রোমান্টিক গল্প কাহিনী
মহাজনের টাকার থলি
ভদ্রলোক টাকার থলে সহ নৌকা করে নদীর ওপারে যাচ্ছিলেন। মাঝ নদিতে হঠাৎ করে নৌকাটা ডুবে যায়। তীরে গোপাল ও তার বন্ধুবান্ধবরা দাড়িয়ে ছিল তারা অনেক কষ্টে ভদ্রলোককে তীরে টেনে তুলতে সমর্থ হয়। নাহলে স্রোতের টানে তাকে অক্কা পেতে হত। কিন্তু মহাজনের ভারি টাকার থলিটি বর্ষার ভরা নদীতে কোথায় তলিয়ে গেল। গোপালরা জানতে পারল না।
ডাঙায় তোলার কিছু পর ভদ্রলোক জ্ঞান ফিরে পেয়ে গোপালদের গালাগাল করতে থাকেন। আমাকে নদী থেকে না তুলে যদি টাকার থলেটি তুলতে পারতেন তবে বুঝতুম একটা বাহাদুরী কাজ করেছেন। আপনারা সব অকর্মার ঢেকি একদম অপদার্থ। এরূপ লোকদের দুচোখে দেখতে পারি না ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব শুনে গোপাল বলে, আপনাকে মানুষ ভেবে জান বাঁচিয়ে মহাদোষ করে ফেলেছি তাই আমরা ঢেকি। যদি আগে জানতাম আপনি অকৃতজ্ঞ জন্তু বিশেষ যার কাছে জানের চেয়ে টাকার থলি বড়, তাহলে আপনার ওই মাংসের ঢিবিকে আমরা স্পর্শও করতাম না। আপনি ঢোক ঢোক লোনা জল খেয়ে টাকার টুং টুং শব্দ শুনতে শুনতে ভবপারে যাওয়ার ঢং ঢং বাদ্যি এতক্ষণ শুনতেন। এই বলে সকলে সেখান থেকে রাগ করে চলে গেল।
Read more: 20 টি সেরা বৃষ্টি নিয়ে কবিতা ও কোটস
গোপালের গোয়েন্দাগিরি
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বের সময় যান-বাহনের খুবই অসুবিধা ছিল। স্থল-পথ ছাড়া জল-পথ দিয়েও লোক যাতায়াত করত। জল পথে বজরাই তখনকার দিনে যাতায়াতের একমাত্র উপায়। এক মহিলাকে প্রায়ই দেখা যেত একটি কাপড়ে জড়িয়ে শিশু কোলে করে নিয়ে বজরায় উঠতে এবং এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করতে। কেউ দেখলে মনে করত এক বছরের মত বয়স শিশুর সর্দ্দি কাশির ভয়ে এমনি ভাবে জড়ান।
গোপাল মাঝে মাঝে পথে বেড়াতে গিয়ে এই ভদ্রমহিলাকে দেখত এবং মনে মনে শিশুটির কথা ভাবত। একদিন কথা প্রসঙ্গে গোপাল মহারাজকে এই মেয়েটির কোলের শিশুটির ব্যাপারে তার সন্দেহের কথা খুলে বলল।
তখনকার দিনে দেশে প্রচুর চুরি ডাকাতি হত চুরি করা মালপত্র সেইসব জলপথে পাচার হয়ে যেত অন্য জায়গায়।
একদিন হঠাৎ যেই মেয়েটির সঙ্গে বজরায় দেখা, অমনি গোপাল ও ওর সঙ্গীরা মেয়েটিকে কোলের শিশু দেখাতে বলে। মেয়েটি কোন মতে শিশু দেখাতে রাজী হয় না। তখন গোপালরা জোর করে মেয়েটিকে কোলের ছেলেটিসহ রাজবাড়ীতে হাজির করে। মহারাজের সামনে ছেলেটিকে কোল থেকে নামাতে দেখা গেল।
এবাবা এত ছেলে নয়, কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় রয়েছে যত রাজ্যের সোনা-দানা চোরাই মাল। বুদ্ধি ও সাহসের বলে চোর ধরার জন্য ও দেশের অনেক উপকার করার জন্য মহারাজ গোপালকে অনেক পুরষ্কার দিলেন।
Read more: অসাধারণ প্রেমের রোমান্টিক গল্প
গোপাল ও বালক
এক বালক গোপালের বাগানে ফল পেড়ে খাচ্ছিল। প্রতিবেশী লোকেরা ছেলেটাকে ধরে নিয়ে এল বাগান থেকে। যথাসময়ে ছেলেটাকে গোপালের কাছে ধরে নিয়ে এসে হাজির করল। ছেলেটার বিচার করবার জন্য গোপালকে বলল দৈব ক্রমে সেই সময় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আর প্রিয়বয়স্য গোপালের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। তার জন্য গোপাল ও সবিনয় মহারাজের উপর বিচারের ভার ছেড়ে দিল।
মহারাজ খুব গম্ভীর হয়ে সেই বালককে লক্ষ্য করে কয়েকটি উপদেশের বানী শুনালেন। চুরি করা ভীষণ দোষ, কারো কোন জিনিষ চুরি করা উচিৎ নয়। যে কোন লোক চুরি করলে ভীষণ শাস্তি পেতে হয়। এইরূপ অনেক কিছু কথা বলার পর মহারাজ সেই বালককে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা তোমার যদি একটা বাগান থাকত আর সেই বাগানে ঢুকে তোমার মত কোন ছেলে যদি ফল চুরি করত তখন তুমি তাকে কি করতে তোমার মুখেই শুনতে চাই বলত দেখি?
বালক বিনিত হয়ে নম্রভাবে বলল, মহারাজ প্রথমবার আর কি করব? বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে যাতে আর কোন দিন চুরি না করে এবং আপনার মত এই উপদেশের কথামত বলে সাবধান করে ছেড়ে দিতাম প্রথম বারের মত। তা ছাড়া আর কি করব বলুন।
বালকের এই কথা শুনে মহারাজ হেসে ফেললেন, মনে মনে ভাবলেন বাঃ ছেলের বিচার বুদ্ধি দেখছি বেশ সুন্দর, ঠিক আছে ওর কথা মত এবার একে সাবধান করে ছেড়ে দেওয়া হোক। বলা বাহুল্য মহারাজ সাবধান করে বালককে ছেড়ে দিলেন। দেখো আর যেন দ্বিতীয়বার তোমার কথামত কোনদিন যেন চুরি না কর। এবারের মত তোমাকে মাফ করে দেওয়া হল তোমারই কথামত।






