বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে মুহাম্মদ আজিজ খান ও সামিট গ্রুপের যত অর্জন

মহান স্বাধীনতার পর থেকে শিল্প ও বাণিজ্যখাতে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। তবে সব বাধা পেরিয়ে এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অবদান অনস্বীকার্য। দেশের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবেন সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এক অনন্য যাত্রার সূচনা করেন। যেকোনো দেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অপরিহার্য অনুসঙ্গ হলো টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামো।

১৯৯৭ সালে অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু করেছিলেন মুহাম্মদ আজিজ খান। দূরদর্শী ভাবনা আর কঠোর পরিশ্রমের কল্যাণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সামিট গ্রুপ দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছে। পাশাপাশি সামিট সুনামের সাথে বন্দর, ফাইবার অপটিকস ও আবাসন খাতে ব্যবসা বিস্তৃত করেছে। আজকে আমরা জানবো কীভাবে মুহাম্মদ আজিজ খানসামিট গ্রুপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠা এবং পথচলা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর দুয়েক পর, অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে মুহাম্মদ আজিজ খানের হাত ধরে একটি ছোট্ট কিন্তু উদ্ভাবনী ব্যবসার সূচনা হয়। যুদ্ধ পরবর্তী ওই সময় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন সচল না থাকায় মূলধনের অভাব বেশ প্রকট ছিল। ফলে মুহাম্মদ আজিজ খান আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন দেশের বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে ব্যবসায়িক সম্ভবনা রয়েছে। এরপর তিনি এই খাতেই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৯৫ সালে মুহাম্মদ মুহাম্মদ আজিজ খান অবকাঠামো খাতে প্রথম বিনিয়োগ শুরু করেন। সেই সময় দেশে আর্থিক সংকটের পাশাপাশি সমুদ্র বন্দরে পণ্য পরিবহন-সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিল না। মুহাম্মদ আজিজ খান ওই সময় প্রথম বেসরকারি বিনিয়োগকারী হিসেবে ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো তৈরী করেন। পাশাপাশি তিনি বন্দর সম্পর্কিত অন্যান্য সুবিধা, ভোজ্য তেল সংরক্ষণের টার্মিনাল ইত্যাদি স্থাপন করেন।

নব্বই দশকের ওই সময় দেশের বিদ্যুৎ খাতও বেশ নাজুক ছিল। ১৯৯৫ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত দেশে মাত্র ২০ শংতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুতের সংযোগ ছিল। ১৯৯৭ সালে সামিট গ্রুপ প্রথম বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সূচনা করে। সময়ের ব্যবধানে এখন বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।

জনাব খান বলেন “ওই সময় (১৯৯৭ সালে) বাংলাদেশের মাত্র ২০-২৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। সামিট গ্রুপ এই যাত্রার অংশীদার হতে পেরে একই সাথে আনন্দিত এবং গর্বিত।”

দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের উন্নয়ন এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা

সামিট গ্রুপের কর্ণধার মুহাম্মদ আজিজ খান বরাবরই সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় বিশ্বাসী। সেই কারণেই তিনি সর্বদা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। শুরুর দিকে সামিট গ্রুপ তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করত। তবে ধীরে ধীরে সামিট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হয়েছে যা তুলনামূলকভাবে কম কার্বন নিঃসরণ করে।

আগামী দিনে সামিট গ্রুপ আন্তঃদেশীয় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ আমদানির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে এই আশাবাদী। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশ চ্যালেঞ্জিং। কারণ বাংলাদেশের মতো বড় আকারে সোলার বা হাইড্রো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে আন্তঃদেশীয় সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানি কার্যকরী সমাধান হতে পারে। আমদানির এই প্রক্রিয়ায় সামিট গ্রুপ নেতৃত্ব দিতে আত্নবিশ্বাসী।

সামিট গ্রুপের বৈদেশিক অংশীদারিত্ব এবং উন্নয়ন

সামিট গ্রুপের সিঙ্গাপুরে নিবন্ধনের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৬ সালে সামিট সিঙ্গাপুরে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামে নিবন্ধিত হয়। একই বছর মুহাম্মদ আজিজ খান, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন তথা আইএফসির সাথে বিনিয়োগের ব্যাপারে একটি বড় চুক্তি করেন। আইএফসি এবং সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের বিদ্যুৎ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং অধিকতর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছ।

সিঙ্গাপুরে চলমান ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে শুধুমাত্র আইএফসি নয় বরং আরও অনেক স্বনামধন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সামিট গ্রুপ বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা পেয়েছে যেমন, ক্লিফফোর্ড ক্যাপিটাল পিটিই লিমিটেড, সুমিটোমো মিতসুই ব্যাংকিং করপোরশন (এসএমবিসি), ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল), ইসলামিক করপোরেশন ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব প্রাইভেট সেক্টর (আইসিডি), ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি) ইত্যাদি। এ ছাড়াও আমেরিকান কোম্পানি জেনারেল ইলেক্ট্রিক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অংশীদার হয়েছে। একইভাবে এফএসআরইউ স্থাপনে সামিটের সাথে স্বনামধন্য জাপানি কোম্পানি মিতসুবিশি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এদিকে জাপানের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ কোম্পানি জেরা ২০১৯ সালে ৩৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে।

শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষিনির্ভর। কিন্তু বর্তমান সময়ে কৃষিকাজের পাশাপাশি শিল্পায়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সেপ্টেম্বর, ২০২৪ এর হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ২৬ লাখ ৬০ হাজার তরুণ-তরুণী বেকার। তবে এর বাইরেও অনেক তরুণ-তরুণী উপার্জন করলেও তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাঙ্খিত মানের কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টির জন্য শিল্পায়নের বিকল্প নেই।

এই প্রসঙ্গে মুহাম্মদ আজিজ খান বলেন, “বাংলাদেশকে খুব দ্রুত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বের হয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির পথে যেতে হবে। সেটা বাস্তবায়ন করা না গেলে ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি হবেনা। আর শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির জন্য প্রধান চালিকাশক্তি হলো বিদ্যুৎ।”

সামিটের বিদ্যুৎ, জ্বালানী, বন্দর এবং তথ্যপ্রযুক্তি–অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ আছে এবং এসব খাতে ৬,০০০ হাজারের বেশি কর্মী নিয়োজিত আছে।

আঞ্জুমান অ্যান্ড আজিজ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট – শিশু শিক্ষার অভিনব উদ্যোগ

শুধুমাত্র কর্মসংস্থান সৃষ্টি নয়, সামিট গ্রুপ শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমান সমাজে সমতা বজায় রাখতে চাইলে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন নয়, বরং বিষয়টি সার্বজনীন। তাই বিভিন্ন খাতে ব্যবসা পরিচালনার পাশপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে মুহাম্মদ আজিজ খান ও তাঁর পরিবার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষাবিস্তারে কাজ করে যাচ্ছেন।

মুহাম্মদ আজিজ খান ও তার স্ত্রী আঞ্জুমান খান যৌথ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন‘আঞ্জুমান অ্যান্ড আজিজ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট,(এএসিটি)’।  ইউনিসেফের ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীদের পাঠাদানের উদ্যোগে অংশগ্রহণসহ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রথম আলো ট্রাস্টের আলোর পাঠশালার সাতটি স্কুল পরিচালনা করে আঞ্জুমান অ্যান্ড আজিজ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও সামিট গ্রুপ। বর্তমানে সামিট গ্রুপ এবং আঞ্জুমান–আজিজ চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৯,৮৪৮ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু বিনা খরচে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে।

মুহাম্মদ আজিজ খান সবসময় জন্মভূমির কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি তাঁর মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের জন্য শিল্পায়নের এক নতুন পথ খুলে দিচ্ছেন। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমিট গ্রুপ এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম অবকাঠামো উন্নয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে

মুহাম্মদ আজিজ খানের দূরদর্শিতা ও মানবিক নেতৃত্ব বাংলাদেশকে একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিল্পায়নের পাশাপাশি, তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও গুরুত্ব দিয়েছেন, যা তাঁকে একজন সফল ব্যবসায়ী ও মানবিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সামিট গ্রুপের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন

বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেগুলো হলো–কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও  দ্রুতগতির কম্পিউটিং। এ কারণে মুহাম্মদ আজিজ খানের আগামী লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে এসব উন্নত প্রযুক্তির বিকাশ নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো। মুহাম্মদ আজিজ খানের মতে, পরিবেশগত পরিবর্তন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশকে একসঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। প্রযুক্তির অগ্রগতি যেন পরিবেশের ক্ষতি না করে, বরং পৃথিবীকে কীভাবে আরও বাসযোগ্য করে তোলা যায় সেটিই লক্ষ্য।

মুহাম্মদ আজিজ খান বলেন “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আমাদের কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে হবে যেন আমাদের এই পৃথিবীর মাটি, জলবায়ু এবং পরিবেশ দূষণ মুক্ত থাকে। এটা অবশ্যই কঠিন একটা কাজ কিন্তু অসম্ভব নয়। সামিট গ্রুপ সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে নিরন্তর।“