বাঙালির ভ্রমণ তালিকায় বরাবরই এক নম্বরে থাকে জগন্নাথ পুরী মন্দির। এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর যারা জীবনে এবার অন্তত পুরী ভ্রমণ এর সফরে যায়নি। আবার কিছু মানুষ আছে যারা হাওয়া বদল করতে উড়িষ্যার এই সমুদ্রতটকেই বেছে নেয়। তবে পুরী শহরের প্রধান আকর্ষণ জগন্নাথ পুরী ধাম ও সমুদ্র সৈকত হলেও পুরী বেরিয়ে আসার জন্য রয়েছে আরও কিছু জায়গার বিশেষত্ব।
তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক, পুরী সাইড সিন এর জন্য এই শহরের আসেপাশে এমন কি কি জায়গা আছে যা পর্যটকদের দেখার মত।
১.পুরীর সমুদ্র সৈকত
পুরী সমুদ্র সৈকত বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি সোনালী সমুদ্র সৈকত। এটি পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র। পুরী ভ্রমনে এসে সমুদ্র সৈকতে ভোরের সূর্যোদয় কিংবা বিকেলের সূর্যাস্ত দেখেনি এমন মানুষ পাওয়া দুস্কর। তাই পুরী বেরাতে এসে সমুদ্র সৈকতের মনোরম দৃশ্য অনুভব করুন।
২. কোনার্ক সূর্য মন্দির
পুরী থেকে ৩৫ কিমি দূরে রয়েছে কোনার্ক সূর্য মন্দির। এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। কোণার্ক সূর্য মন্দির ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত ওড়িশার পুরী জেলার কোণার্ক শহরে অবস্থিত। মন্দিরটি ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে গঙ্গা রাজবংশের রাজা প্রথম নরসিংহদেব এটি নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও কোণার্কের আশেপাশে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে নেওয়া যেতে পারে যেমন রামচণ্ডী, চন্দ্রভাগা, কাকতপুর, কুরুমা, চৌরাসি, বালিঘাই ইত্যাদি।
৩. সাক্ষীগোপাল মন্দির :
পুরীর জগন্নাথ মন্দির ছাড়াও আধ্যাত্মিকতার অভিজ্ঞতার জন্য, ঘুরে আসতে পারেন পুরীর সাক্ষীগোপাল মন্দির দর্শনে। পুরী থেকে ভুবনেশ্বর যাওয়ার পথে, পুরী শ্রী জগন্নাথ মন্দির থেকে সাক্ষিগোপাল মন্দির ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যে কোন গাড়িতে ৩০ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যায় এই মন্দিরে। পুরী জগন্নাথ মন্দির ঘুরতে এসে অনেকেই দর্শন সেরে যান এই গোপাল মন্দিরে।
৪. ললিতগিরি, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি :
ইতিহাস ভালোবেসে থাকলে পুরী থেকে ঘণ্টা তিনেকের দুরত্বে বেরিয়ে আসতে পারেন, ললিতগিরি, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি। এরমধ্যে ললতিগিরি উড়িষ্যার সবচেয়ে প্রাচীণ বৌদ্ধ নিদর্শনগুলির মধ্যে অন্যতম। যা মৌর্য সম্রাজ্যের সমসাময়িক। আর উদয়গিরিতে রয়েছে উড়িষ্যার সবচেয়ে বড় বৌদ্ধস্তুপ।
৫. চিলিকা লেক
আরেকটি বিশেষ পর্যটক আকর্ষণ হল ওড়িশার চিলিকা হ্রদ। পুরী থেকে চিলিকা হ্রদের দূরত্ব প্রায় ৩৭ কিলোমিটার। এটি একটি অভ্যন্তরীণ নোনা জলের হ্রদ যা ছোট ছোট দ্বীপ দ্বারা বেষ্টিত। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে বেড়াতে আসে। এই জায়গায় আপনি ডলফিন দেখতে পারেন, বিভিন্ন পাখি দেখতে পারেন এবং নৌকা চালানো উপভোগ করতে পারেন।
৬. রঘুরাজপুর গ্রাম :
উড়িষ্যার বিখ্যাত পটচিত্র দেখতে অবশ্যই যেতে হবে পুরীর রঘুরাজপুর গ্রামে। পুরী থেকে মাত্র চোদ্দ কিলোমিটার দূরে এই ছোট্ট গ্রাম রঘুরাজপুর। এককোথায় এই জায়গাকে শিল্পপ্রেমীদের স্বর্গ বলা যেতে পারে। রঘুরাজপুর আর্টিস্ট ভিলেজ হল পুরীতে শিল্প ও কারুকাজ প্রেমীদের জন্য দেখার মতো আরেকটি জায়গা।এখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পট্টচিত্র চিত্রকলার প্রাচীন শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন শিল্পীরা।
এখানে শিল্পীদের আঁকা প্রায় বেশিরভাগ চিত্রগুলি হিন্দু পৌরাণিক মূর্তিগুলির চিত্রিত হয় এবং প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে তাল পাতায় করা হয়। এখানে প্রায় ১৫০টি বাড়ি রয়েছে এবং তাদের প্রতিটি রঙিন চিত্রে সজ্জিত। শিল্পীদের সূক্ষ্ম হাতের কাজ যা শিল্পপ্রেমী মানুষদের মুগ্ধ করবেই।
৭. গুন্ডিচা মন্দির :
জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গুন্ডিচা মন্দিরকেই অনেকে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি বলে মনে করে থাকেন। অনেকে মনে করেন, এই মন্দিরের স্থানীয় দেবীর নাম গুন্ডিচা। গুটিবসন্ত রোগকে ওড়িয়া ভাষাতে বলা হতো ‘গুন্ডি’। এই দেবীকে, রোগ নিরাময়ের দেবী বলে মনে করা হয়। রথযাত্রা উৎসবের সময় এই গুন্ডিচা মন্দিরেই জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রার এই ত্রিমূর্তিকে ৭ দিন রাখা হয়। সারা বছরেই গুন্ডিচা মন্দিরে দর্শনার্থীরা ভিড় করেন। তবে রথের সময় দর্শনার্থীদের ভিড় অনেক বেড়ে যায়এই মন্দিরে।
৮. বালুখন্দ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য :
কখনও একটি বন বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সঙ্গে মিলিত একটি সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা দেখেছেন? তাহলে পুরী থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটারের দুরত্বে, বালুখন্দ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য থেকে ঘুরে আসতে পারেন। এই অভয়ারণ্য ঘুরে দেখার সময় সকাল ৭ টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫ টা পর্যন্ত।
৬. মার্কন্ডেশ্বর মন্দির :
পুরীর সেরা মন্দিরগুলির মধ্যে একটি হল মার্কন্ডেশ্বর মন্দির। যেখানে ঋষি মার্কন্ডেয় অল্পবয়সে ভগবান শিবের ধ্যান করেছিলেন। মন্দিরটি তার দুর্দান্ত স্থাপত্য এবং নান্দনিক আকর্ষণীয়তার কারণে সারা বিশ্ব থেকে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।
৭. নরেন্দ্র ট্যাঙ্ক
জগন্নাথ মন্দির থেকে ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নরেন্দ্র ট্যাঙ্ক পুরীর কাছে ওড়িশার বৃহত্তম ইকো-ট্যুরিজমগুলির মধ্যে একটি। নরেন্দ্র ট্যাঙ্ক, পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এটি পুরীর অন্যতম দর্শনীয় আকর্ষণ এবং উড়িষ্যার অন্যতম বড় ট্যাঙ্ক। এর চারপাশে অনেক ছোট-বড় মন্দির রয়েছে। হ্রদের মাঝখানে একটি দ্বীপ রয়েছে যার নাম চন্দনা মণ্ডপ।
নরেন্দ্র ট্যাঙ্কের বিশাল কাঠামো মূলত চন্দনা যাত্রার জন্য পরিচিত যা চন্দনা পুষ্করিণী নামেও পরিচিত। এই উৎসবের সময় ছোট-বড় সকল দেব-দেবীকে তাদের মন্দির থেকে বের করে এই হ্রদের পবিত্র জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই আচারের অধীনে জগন্নাথদেবকেও বছরে একবার এই হ্রদে নিয়ে যাওয়া হয় স্নান করানোর জন্য। এই জায়গাটি ঘুরে দেখার জন্য সময় সকাল ৬ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত।
৮. আথরনালা সেতু :
উইকএন্ডে পুরীর কাছাকাছি ঘুরে দেখার মত একটি জাউগা হল আথারনালা ব্রিজ, যার দৈর্ঘ্য প্রায় 85 মিটার এবং প্রস্থ 11 মিটার, এটির 18টি খিলান রয়েছে, যার উচ্চতা সাত থেকে ষোল ফুট। আথারনালা সেতুর সামনের অংশটি দেবতা, নায়িকা, ঘরানার অবস্থান এবং পুষ্পশোভিত উচ্চারণে সজ্জিত।এই ব্রিজটি একটি ল্যাটেরাইট এবং চুন মর্টার দিয়ে অ্যাশলার পাথর ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল।
৯. সূদর্শন ক্রাফ্ট মিউজিয়াম :
পুরীর স্টেশন রোড থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে রয়েছে সুদর্শন ক্রাফ্ট মিউজিয়াম। ১৯৭৭ সালে নির্মিত এই জাদুঘরটি তৈরি করেন বিখ্যাত শিল্পী শ্রী সূদর্শন সাহু। এই জাদুঘর, স্থানীয় ও রাজ্যের বিভিন্ন শিল্পকীর্তির পাশাপাশি নানা অজানা অচেনা তথ্যের সাথে আমাদের পরিচয় করাবে। শিল্পী সুদর্শন সাহুর নিজহাতে তৈরি করা কাঠের তৈরি শিল্প, পাথের উপর খোদাই করা নিদর্শন, ফাইবারগ্লাসের তৈরি হ্যান্ডক্রাফ্ট-সবই দেখতে পাবেন এই মিউজিয়ামে।
১০. পিপিলি :
পুরী থেকে দূরত্ব ৪০ কিলোমিটারের মতো দূরে পিপিলি গ্রাম, যা কাপড়ের উপরে কাপড় দিয়ে নকশা তোলা অর্থাৎ অ্যাপ্লিক কাজের জন্য বিখ্যাত। পিপলি গ্রামের শিল্পকর্ম অনেক প্রাচীন। এখানকার শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় যেন জাদু আছে। জগন্নাথ দেবের রথের সজ্জার জিনিস তৈরি, জগন্নাথ দেবের বালিশ থেকে শুরু করে মন্দিরের চাঁদোয়া, শামিয়ানা সবই নিজের হাতে তৈরি করেন এই গ্রামের শিল্পীরা।
পুরী দর্শনীয় স্থান গুলো ছাড়াও অনেকে মিস করে যান মোহনা। সমুদ্র সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কতখানি অপরূপ তা এই জায়গায় না আসলে হয়ত বোঝা যাবে না। তাই পুরী বেরাতে এসে সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ুন মোহনার উদ্দেশ্যে। ভিড়ভাট্টাও কম এই জায়গায় কিছুটা সময় কাটাতে বেশ ভালোই লাগবে। মোহনা দেখে ফেরার পথে ঘুরে নিন গুপ্ত বৃন্দাবন, ওঙ্কারেশ্বর মন্দির।