মহাকালেশ্বর মন্দির এর আশেপাশে ঘোরার জায়গা

মহাকালেশ্বর মন্দির

Places to visit around Mahakaleshwar Temple

উজ্জয়িনী হল মধ্যপ্রদেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শহর। সেইসাথে আধ্যাত্মিক তাত্পর্য এবং প্রাচীন মন্দিরগুলির জন্যও বেশ পরিচিত এই শহরটি। সারা বছরই এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। এই শহরের প্রধান বিশেষত্ব মহাকালেশ্বর মন্দির । এছাড়াও রয়েছে একাধিক মন্দির যা পর্যটকদের জন্য বিশেষ দর্শনীয়। তাই আজকের আলোচনায় আপনাদের জন্য রইল উজ্জয়িনী শহরে ঘুরে দেখার মত বিশেষ কিছু জায়গার সন্ধান

কাল ভৈরব মন্দির

1. কাল ভৈরব মন্দির

উজ্জয়িনী শহরে মহাকালেশ্বর ছাড়াও দেবাদিদেব মহাদেবের আরও এক রুপ অধিষ্ঠান করছে, যিনি কাল ভৈরব নামে পরিচিত। তন্ত্র সাধনার প্রধান দেবতা হলেন এই কালভৈরব । যিনি বাকি ৮ ভৈরবের মধ্যে অন্যতম।

স্কন্দ পুরাণের ‘অবন্তী খণ্ড’-এ প্রথম এই কালভৈরব মন্দিরের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। ৯০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভদ্রসেন নামে এক রাজা এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন।

কালভৈরবের এই মূর্তিটি সিঁদুরে মাখা। মূর্তির মাথায় রয়েছে একটি পাগড়ি। এই মন্দিরে পূজা দেওয়ার রীতি তেও রয়েছে এক অজানা রহস্য। কাল ভৈরবের পূজায় নিয়মিত মদ্য পানীয় নিবেদন করা হয়। পুরোহিত একটি পাত্রে মদ ঢেলে মূর্তির মুখে ঠেকিয়ে ঢালতে থাকেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেই পানীয় মূর্তির গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে না। এই রহস্য আজও অজানা। উজ্জয়িনী শহরের মানুষরা আজও কালভৈরবকে তাদের প্রধান দেবতা জ্ঞানে পুজো করে থাকেন।  

রাম ঘাট

2. রাম ঘাট

উজ্জয়িনী শহরে ঘুরে দেখার মত সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান গুলির মধ্যে একটি হল রাম ঘাট মন্দির। প্রতি ১২ বছর অন্তর কুম্ভমেলার আয়োজন করা হয় এই শহরে, আর হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী জানা যায় কুম্ভমেলার এই পবিত্র তিথিতে রাম ঘাটে স্নান করলে পুন্য অর্জন করা যায়। আর সেই কারনেই প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত পুন্য অর্জনের জন্য ছুটে আসেন এই শহরে।

কালিয়াদেহ প্রাসাদ

3. কালিয়াদেহ প্রাসাদ

ঐতিহাসিক প্রাসাদটি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে শিপ্রা নদীর একটি দ্বীপে অবস্থিত। প্রাসাদটি উজ্জয়নের রাজকীয় অতীত এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যকে ব্যাখ্যা করে। ১৪৫৮ সালে, মান্ডু শাসকরা প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন। কালিয়াদেহ প্রাসাদটি পারস্যের স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হয়েছিল। পিন্ডারিদের শাসনামলে, এটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে ১৯২০ সালে মহারাজা মাধব রাও সিন্ধিয়া প্রথম দ্বারা সংশোধন করা হয়েছিল।

প্রাসাদটি খুবই শান্ত পরিবেশে হওয়ায় এখানকার আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

হরসিদ্ধি মন্দির

4. হরসিদ্ধি মন্দির

উজ্জয়ন জংশন থেকে ২.৫ কিমি দূরে, হরসিদ্ধি মন্দির মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরে অবস্থিত একটি পবিত্র হিন্দু মন্দির। মহাকাল মন্দিরের কাছে অবস্থিত এই মন্দির এই শহরে অন্যতম দর্শনীয় ধর্মীয় স্থান গুলির মধযেই পরে।

মহাসরস্বতী এবং মহালক্ষ্মীর মিলিত রূপ হিসাবে দেবী অন্নপূর্ণার আরাধনা করা হয় এই মন্দিরে। শুধু তাই নয়, হরসিদ্ধি মন্দির মাতা সতীর ৫১ টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি। পুরান মতে, দেবী পার্বতী যখন যজ্ঞের আগুনে চলে গিয়েছিলেন, তখন ভগবান শিব তাঁর দেহ বহন করেছিলেন এবং তাঁর কনুই এখানে পড়েছিল এবং এইভাবে মন্দিরটি অস্তিত্ব লাভ করেছিল।

মন্দিরের স্থাপত্যে কিছু মারাঠা প্রভাব রয়েছে। মন্দিরে মোট চারটি প্রবেশপথ রয়েছে, প্রতিটি দিকে একটি করে এবং মূল প্রবেশপথটি পূর্ব দিকে। একটা সময় পর্যন্ত এই মন্দিরটি ভগ্নপ্রায় ছিল। তবে পরে মারাঠাদের তত্ত্বাবধানে মন্দিরটি পুনঃগৌরব ফিরে পায়।

সন্দীপনি আশ্রম

5. সন্দীপনি আশ্রম

সন্দীপনি আশ্রম হল একটি পবিত্র মন্দির যা মহর্ষি সন্দীপানীর স্মরণে নির্মিত এবং উজ্জয়িনী শহরে বিখ্যাত পর্যটন স্থান গুলির মধ্যে একটি।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে এটি সেই আশ্রম যেখানে গুরু সন্দীপনি শ্রী কৃষ্ণ, তাঁর বন্ধু সুদামা এবং ভগবান কৃষ্ণের ভাই বলরামকে শিক্ষা দিতেন। এই আশ্রমে গুরু সন্দীপনীর সাথে কৃষ্ণ, বলরাম এবং সুদামার তিনটি মূর্তি রয়েছে। এখানে একটি পাথরও রয়েছে যেখানে ১ থেকে ১০০ সংখ্যা খোদাই করা আছে এবং বিশ্বাস করা হয় যে এটি গুরু সন্দীপনি নিজেই করেছিলেন।

সর্বেশ্বর মহাদেব রুপে ৬০০০ বছরের পুরনো শিবলিঙ্গ রয়েছে, বিশ্বাস করা হয় যে গুরু সন্দীপনি ও তাঁর শিষ্যরা নিয়মিত পূজা করতেন মহাদেবের।

বিশাল এবং বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থাকা এই আশ্রমে গোমতী কুন্ড নামে একটি বিশাল সোপানযুক্ত জলাশয়ও রয়েছে। এই পুকুরের জল অতীব পবিত্র বলে বিশ্বাস করা হয়।

পীর মতসেন্দ্রনাথ

6. পীর মতসেন্দ্রনাথ

উজ্জয়িনী শহরের পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হল পীর মতসেন্দ্রনাথ। শিপ্রা নদীর তীরে অবস্থিত এই স্থাপত্যটি মতসেন্দ্রনাথের নামকরণে করা হয়েছে। যিনি শৈব নাথ সম্প্রদায়ের অন্যতম সম্মানিত সদস্য ছিলেন। চারপাশে ছোট ছোট মিনার দ্বারা ঘেরা গম্বুজ সহ এই স্থাপত্যের কাঠামো, আশেপাশের পরিবেশ যেন এক আলাদাই প্রশান্তি দেয়। ভিন্ন ধর্মের পর্যটকরাই এই স্মৃতিসৌধটি পরিদর্শন করতে আসেন।

ভর্ত্রিহরি গুহা

7. ভর্ত্রিহরি গুহা

ভর্ত্রিহরি গুহার নামকরণ করা হয়েছে ভর্ত্রিহরির নামে, যিনি তার প্রজ্ঞা এবং কাব্যিক দক্ষতার জন্য পরিচিত একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। ভর্ত্রিহরিকে উজ্জয়িনী শহরের একজন বিখ্যাত শাসক রাজা বিক্রমাদিত্যের বড় ভাই বলে মনে করা হয়।

কথিত আছে,এই গুহাতে ধ্যান করেই ভর্ত্রিহরি তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিলেন যা দেবতাদের শাসক ইন্দ্রকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় দেবরাজ ইন্দ্র ভর্ত্রিহরির ধ্যানের একাগ্রতা ভঙ্গ করতে এই গুহা ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। তখন ভর্ত্রিহরি তার হাতের তালু দিয়ে গুহার ছাদ ধসে পড়া বন্ধ করেছিলেন। আজও গুহার ছাদে ভর্ত্রিহরির হাতের তালুর ছাপ রয়ে গেছে।

ইসকন মন্দির 

8. ইসকন মন্দির 

সাদা মার্বেল দিয়ে নির্মিত, চারপাশে বাগানে ঘেরা ইসকোন মন্দিরটি উজ্জয়িনী শহরে দেখার মতো একটি জায়গা। রাধা-কৃষ্ণের সাক্ষ্য প্রদানকারী এই মন্দিরটি দেখলেই যেন চোখ জুরিয়ে যায়। মন্দিরে গোপীদের সাথে রাধা-কৃষ্ণের এবং বলরামের সাথে কৃষ্ণের একটি অনন্য মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।

চিন্তামন গণেশ মন্দির

9. চিন্তামন গণেশ মন্দির

চিন্তামন গণেশ মন্দিরটি উজ্জয়িনী শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। ভগবান শ্রী গণেশের এই মন্দিরটি উজ্জয়িনী থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে ফতেহাবাদ রেললাইনের কাছে অবস্থিত। এই মন্দিরে ভগবান শ্রী গণেশের তিনটি রূপ একত্রে বিরাজমান, যা চিতামন গণেশ, ইচ্ছামন গণেশ এবং সিদ্ধিবিনায়ক নামে পরিচিত।

এই মন্দিরে ভগবান গণেশ চিন্তামণির মতো আচরণ করেন বলে তাকে চিন্তামণি গণেশ বা চিন্তামন গণেশ নামে ডাকা হয়। তিনি ভক্তদের সমস্ত চিন্তা-দুঃখ দূর করেন বলে তাকে চিন্ত হরণ গণেশ নামেও ডাকা হয়।

যন্তর মন্তর

10. যন্তর মন্তর (বেদশালা বা মানমন্দির) 

মহারাজা জয় সিং দ্বারা ১৭ শতকে নির্মিত, ভেধ শালা অবজারভেটরি, যা ‘যন্তর মন্তর’ নামেও পরিচিত, এটি উজ্জয়িন শহরের মধ্যে অবস্থিত অমূল্য রত্নগুলির মধ্যে একটি। মানমন্দিরটিতে যন্ত্র বা যন্ত্রের একটি চিত্তাকর্ষক পরিসর রয়েছে যা জ্যোতিষশাস্ত্রের অধ্যয়ন এবং গবেষণা পরিচালনা করতে ব্যবহৃত হয়। এটি জ্যোতিষী এবং হিন্দু পণ্ডিতদের স্বর্গীয় বস্তুর অবস্থান এবং গতিবিধি অধ্যয়ন করতে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল।

গোপাল মন্দির

11. গোপাল মন্দির

জমজমাট বিগ মার্কেট স্কোয়ারের মাঝখানে অবস্থিত এই গোপাল মন্দিরটি উজ্জয়নের জনপ্রিয় তীর্থস্থানগুলির মধ্যে একটি। মন্দিরটি ১৯ শতকে মারাঠা রাজা দৌলতরাও শিন্দের স্ত্রী বায়াজি বাই শিন্ডে তৈরি করেছিলেন। মহাকালেশ্বরের পর উজ্জয়িনের দ্বিতীয় বৃহত্তম মন্দির গোপাল মন্দির। মন্দিরে ভগবান কৃষ্ণের একটি দুই ফুট উচ্চ রৌপ্য-সোনার মূর্তি রয়েছে।

গড়কালিকা মন্দির

12. গড়কালিকা মন্দির

প্রাচীন কবি কালিদাস গড় কালিকা দেবীর উপাসক ছিলেন। কালিদাস সম্পর্কে মনে করা হয় যে যখন থেকে তিনি এই মন্দিরে পূজা শুরু করেন, তখন থেকেই তার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের বিকাশ শুরু হয়। কালিদাস রচিত ‘শ্যামলা দন্ডক’ মহাকালী স্তোত্র একটি সুন্দর রচনা। কথিত আছে যে এই স্তোত্রটি সর্বপ্রথম মহাকবির মুখ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে প্রতি বছর কালিদাস উৎসবের আগে দেবী কালিকা পূজা করা হয়।

মঙ্গলনাথ মন্দির

13. মঙ্গলনাথ মন্দির

মঙ্গলনাথ মন্দিরটি মহাদেবকে উত্সর্গীকৃত কারণ পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বলা হয় যে একটি অসুরের সাথে লড়াই করার সময় মহাদেবের এক ফোঁটা ঘাম এখানে পড়েছিল যা পরবর্তীতে শিবলিঙ্গের স্বরুপে জন্ম নেয় এবং এই মন্দিরে অধিষ্ঠান করে। মন্দিরটি অনেক পুরাণের উপর ভিত্তি করে ধর্মীয় গল্পের জন্য পরিচিত।

এছাড়াও রালামন্ডল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, জনপাভ কুটি, বিক্রম কীর্তি মন্দির, নবগ্রহ মন্দির, রাম-জনার্দন মন্দির সহ একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে এই শহরে।