রুপকথার গল্প পড়তে কে না ভালবাসে। ছোটবেলায় রুপকথার গল্প পড়তে পড়তে আমরা প্রায়ই হারিয়ে যেতাম কল্পনার রাজ্যে। রাজপুত্র, রাজকন্যা, ড্রাগন, পরী, জাদুকর সব মিলিয়ে রূপকথার গল্প শিশুদের কল্পনাশক্তি যেমন বাড়ায়, তেমনি বড়দের মনেও জাগিয়ে তোলে শৈশবের স্মৃতি। আজকে এমন কিছু রূপকথা গল্প বলব যা মজাদার হলেও জীবনে শিক্ষা দেবে।
Read more: সফলতার শিক্ষনীয় গল্প যা জীবন বদলে দেবে
রূপকথা গল্প ১ : বোকাকুমির আর হরিণ
বনে বনে ঘুরে হরিণ খুব ক্লান্ত। পিপাসা পেয়েছে তার, জল পায় কোথায়? পাশেই ছিল নদী। হরিণ চলল নদীর কাছে জল খেতে। যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল সে। কারণ হরিণ জানে নদীতে কুমির আছে। পাড়ের কাছাকাছি লুকিয়ে চুরিয়ে আছে জলের তলায়। যেই নামবে জল খেতে, খপাৎ করে পা-টা ধরে নিয়ে যাবে জলের তলায় আর তারপর খেয়ে ফেলবে। তাহলে হরিণ জল খাবে কী করে?
হরিণ মনে মনে একটা মতলব আঁটল। সে মিচিমিচি চেঁচিয়ে বলল, দেখি তো নদীর জলটা কি সত্যি সত্যি গরম? আমি বরং আগে-ভাগে পা ডুবিয়ে দেখে নিতে চাই। তারপর খেতে হয় খাব। এরপর সেটা না করে মুখে করে একটা লাঠি নিয়ে তার অন্য প্রান্তটা জলের মধ্যে রাখল।
লাঠি রাখতেই, খপাৎ করে লাঠিটা কুমির নিয়ে গেল এক্কেবারে জলের তলায়। আর অমনি হি হি করে হেসে উঠল হরিণ। হাসতে হাসতে হরিণ বলল, কী বোকা কুমির, কোনটা লাঠি আর কোনটা সত্যিকারের পা সেটাও চেনে না। এরপর হরিণ খানিক দূরে নদীতে গিয়ে মজা করে জল খেয়ে ফিরে গেল বনে।
আবার অন্য আরেকদিন হরিণ এসেছে জল খেতে। এসে দেখে কী, নদীতে একটা কাঠের বড়ো টুকরো ভাসছে। হরিণ জানে কুমির যখন জলে ভাসে তখন তাকে ঠিক কাঠের টুকরোর মতো দেখায়। মনে মনে আবার মতলব আঁটল হরিণ।
হরিণ আবারও চেঁচিয়ে বলল, কাঠের টুকরোটা সত্যি যদি কুমির হয় তবে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। কুমির না হয়ে আর সত্যি যদি কাঠের টুকরোই হয় তবে আমার সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দেখে। হরিণের কথা শেষ হতেই অমনি সে শুনতে পেল একটা কর্কশ আওয়াজ। জলের তলায় মুখ রেখে কুমির বলল, বিশ্বাস করো, আমি সত্যি কাঠের টুকরো।
হরিণ মনে মনে ভাবল কাঠের টুকরো আবার কথা বলতে পারে নাকি? সেটা কখনো হয়! তাই তো হরিণ হি হি করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে ভাবল, বোকা কুমির এটাও জানে না। তারপর হরিণ ফিরে গেল বনে।
নদীর এপারে থাকতে তার আর ইচ্ছে করছিল না হরিণের। নদীর ওপারে নাকি প্রচুর রসালো ফলমূল আর কচি কচি পাতা আছে। সে সব খাওয়ার ইচ্ছে হল তার। কিন্তু নদী পেরোবে কী করে? নদী পেরোবার আগেই যদি কুমির তাকে খেয়ে ফেলে। এবারও হরিণের মাথায় এল একটা দুর্দান্ত মতলব। যেই না আসা হরিণ চেঁচিয়ে উঠল, ওহে কুমির ভায়া…
তক্ষুনি জলের নীচ থেকে গর্জন করে উঠল কুমির, আরে আরে হরিণভায়া যে। আমার সকালের ভোজনের জন্য বুঝি তুমি এসেছ?
হরিণ বলল, না না কুমিরভায়া। আজকে আমি অন্য একটা কাজ নিয়ে এসেছি তোমার কাছে। রাজা আমাকে পাঠিয়েছেন। এই নদীতে কত কুমির থাকে আজই গুনে তাকে বলতে হবে।
কুমির খানিকটা ভয় পেয়েই বলল, রাজা বলেছেন? তা আমাদের কী করতে হবে শুনি।
হরিণ বলল, তেমন কিছুই না। তোমরা সব কুমির নদীর এপার থেকে ও-পার পর্যন্ত সার দিয়ে ভেসে থাকো। আমি এক দুই তিন চার করে পর পর সব গুনে নেব।
হরিণের কথা শুনে কুমির চলে গেল তার পরিবারের লোকজনদের খবর দিতে। তারপর একে একে পাড়াপড়শি বন্ধুবান্ধব যারা ছিল সবাইকে খবর দিয়ে জড়ো করে সার দিয়ে ভেসে থাকতে বলল। সবাই হাজির। হরিণ বলল, এবার গোনা শুরু।
হরিণ একটা করে কুমিরের পিঠে লাফায় আর বলে, এক, তার পরেরটার পিঠে উঠে বলল, দুই! এমনি করে তিন….চার… পাঁচ। যতক্ষণ না হরিণ নদীর ওপাড়ে নামল। গোনা থামতেই কুমির চিৎকার করে উঠল, গোনা শেষ হয়েছে? হরিণ বলল, আসলে তোমরা বোকার হদ্দ। কুমিরকে বোকা বানিয়ে গান গাইতে গাইতে হরিণ চলল নতুন বনের খোঁজে।
Read more: একটি ভালোবাসার রোমান্টিক গল্প কাহিনী
রূপকথা গল্প ২ : আয়নার রাজ্য
অনেক দূরে এক রাজ্যে ছিল এক অদ্ভুত দুর্গ। যার চারপাশ ছিল কাচ দিয়ে ঘেরা, ভিতরে ছিল শুধু এক জাদুকরী আয়না। এই আয়নায় দেখা যেত না নিজের চেহারা, বরং দেখা যেত নিজের মনের ভেতরের রূপ। এই রাজ্যেই বাস করতেন রাজকুমার জিয়ান। সুদর্শন, বুদ্ধিমান, কিন্তু ভেতরে অহংকারে ভরা ছিল রাজার মন।
রাজ্যের নিয়ম ছিল, ২১ বছর পূর্ণ হলে রাজপুত্রকে সেই আয়নায় নিজের মুখ দেখাতে হবে। যদি তার মনের রূপ সুন্দর হয়, তবে সে রাজ্যের সিংহাসন পাবে। আর যদি মন হয় হিংসা-অহংকারে ভরা, তবে আয়না তাকে চিরতরে সরিয়ে দেবে রাজ্য থেকে।
জিয়ান জানত, আয়নাটি কাউকে ক্ষমা করে না। তাই সে চেষ্টা করত বাহ্যিকভাবে ভালো হতে, দান করত, দরিদ্রদের সামনে অভিনয় করত। কিন্তু আসলে তার মন ছিল অহংকারে ভরা।
একদিন দুর্গের বাইরে জঙ্গলে সে হারিয়ে যায় এবং পরিচিত হয় একটি মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটির নাম এলিনা। এলিনা ছিল অতি সাধারণ এক কুমারী, তার পড়ে থাকা পোশাক ছেঁড়া হলেও, চোখে ছিল আলো, আর কথায় ছিল ভালোবাসা। জিয়ান প্রথমে এলিনাকে উপেক্ষা করলেও, এলিনার ব্যবহার, সহানুভূতি, আর অন্যদের প্রতি তার নিঃস্বার্থ মনোভাব জিয়ানকে ধীরে ধীরে বদলে দিতে থাকে।
দিন চলে যায় যায়, রাজকুমার ও এলিনার মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। জিয়ান প্রথমবার নিজের অনুভূতি শেয়ার করতে শেখে, অহংকার ফেলে বিনয় অর্জন করে।
২১তম জন্মদিনে, রাজা তাকে ডাকে আয়নার ঘরে। পুরো রাজ্য তাকিয়ে আছে। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই জিয়ান থমকে যায়। আয়নায় সে দেখে—এক পুরুষ যার চোখে ক্ষমা, মনে দয়া, মুখে শান্তি।
সবাই অবাক, আয়না এবার জ্বলে উঠল সোনালী আলোয়। আয়না বলল, রাজ্য তারই প্রাপ্য, যার হৃদয় সত্যিকারে সুন্দর।
সেই মুহুর্তে জিয়ান হাঁটু গেড়ে বসে আয়নার সামনে বলল, আমার এই রূপ এলিনার উপহার। ওর মতো একজন সাধারণ মেয়ে আমাকে শিখিয়েছে, কীভাবে ভালোবাসতে হয়। জিয়ানের মুখে এমন কথা শুনতেই রাজা ঘোষণা দেন এলিনাই হবে এ রাজ্যের রানী।
Read more: অসাধারণ প্রেমের রোমান্টিক গল্প
রূপকথা গল্প ৩ : চালাক শিয়ালের গল্প
একদিন শিয়াল বন থেকে ঘুরে ফিরছে। হঠাৎ সে দেখতে পেল, এক বিশাল সিংহ একটি হরিণ শিকার করে ফেলেছে। হরিণটা খুব বড়, গায়ে মাংসও আছে বেশ। শিয়ালের জিভে জল এসে গেল। তখনই শিয়াল ভাবল, সিংহ তো একা এতটা খেতে পারবে না। যদি একটু চালাকি করে, কিছু মাংস পাওয়া যেত!
শিয়াল সোজা সিংহের সামনে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, মহামান্য সিংহরাজ! আপনি একা এই বিশাল হরিণ খেয়ে ফেলবেন? এটা তো রাজ্যের অন্য পশুদের জন্য অবিচার হবে। তাই আমি সুস্থ বুদ্ধি দিয়ে শিকার ভাগ করে দিচ্ছি।
সিংহ বলল, ভাগ? দেখাই তো যাক তুমি কতটা বিচারজ্ঞানসম্পন্ন! শিয়াল অমনি বলল, এই হরিণের এক পা আপনার, এক পা আমার, এক পা রাজার রাজভাণ্ডারে, আর এক পা প্রজাদের জন্য। মাথা যাবে শিকার বিভাগে, আর লেজ দিয়ে পরিষ্কার কাজ করা হবে। তাই পুরোটা আলাদা করে নেয়া দরকার।
শিয়ালের কথায় সিংহ রেগে গর্জে উঠল, তুই তো আমাকে দিলি এক পা! বাকিটা ভাগ করে দিলি? এ কথা শুনে শিয়াল চট করে সিংহের পায়ে পড়ে বলল, ক্ষমা করবেন রাজা। আমি তো পরীক্ষা নিচ্ছিলাম আপনার ধৈর্যের! দেখলাম আপনি কত সহনশীল।
সিংহ কিছুটা শান্ত হয়ে বলল, তুই খুব চালাক… কিন্তু মনে রাখিস, বেশি চালাকির শেষ ভালো হয় না। শিয়াল মাথা নিচু করে হাসি চেপে ফিরে গেল, আর ভাবে, সিংহ তেলেবেগুনে জ্বলে, আর আমি চালাকি করে মাংসের ভাগ বুঝে নিই এই তো আমার কাজ!
Read more: 20 টি সেরা বৃষ্টি নিয়ে কবিতা ও কোটস
শেষকথাঃ
রূপকথা গল্প গুলো শুধুই আমাদের বিনোদনের জন্য নয়, বরং গল্পের প্রতিটা চরিত্র ও ঘটনা আমাদের মুল্যবান বার্তা দিয়ে যায়। রূপকথার গল্প গুলোই আমাদের শেখায় অন্ধকারের শেষেই আলো আসে, সর্বত্র সততা আর ভালবাসার জয় নিশ্চিত। রূপকথার গল্প শুধু শিশুদের কল্পনাশক্তি, নৈতিকতা বিকাশে অবদান রাখে না, বড়দের জন্য হতে পারে সারাদিনের ব্যস্ততার ক্লান্তির মাঝে একটু মন ভাল করার উপায়।

