অভিনেতা দেবজিৎ সরকার বাংলা ইন্ডাস্ট্রির এক পরিচিত মুখ। ছোট পর্দার দর্শক তাকে “পুরকায়স্থ বাবু” হিসাবেই বেশি চেনেন। হ্যাঁ, এখানে সেই নেগেটিভ চরিত্রের কথা বলা হচ্ছে যিনি ‘ফিরকি’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে দর্শকের মনে সাড়া ফেলেছেন। ধারাবাহিকের পাশাপাশি ওয়েব সিরিজেও ভিলেন চরিত্রে প্রশংসা কুড়িয়েছেন এই অভিনেতা। এই মুহূর্তে টিভির পর্দায় শন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৃজলা গুহ অভিনীত ‘মন ফাগুনে’-এ গুরুত্বপূর্ণ এক নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করছেন দেবজিৎ ।
ধারাবাহিক হোক বা সিনেমা, সাফল্য অর্জনের জন্য মুখ্য চরিত্রের পাশাপাশি নেগেটিভ চরিত্রগুলিরও অবদান রয়েছে। অনেক সময় মুখ্য চরিত্রকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দর্শক এই নেগেটিভ চরিত্রগুলিকে গুরুত্ব দিতে ভুলে যান। যারা টিভির পর্দায় সুন্দরভাবে নিজেদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। নিজের বেস্ট দিয়ে দর্শকের মনে টিকে থাকাটাই যাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের মধ্যেই একজন হলেন অভিনেতা দেবজিৎ সরকার। জন্মদিনে নিজের স্ট্রাগলের কথা শেয়ার করলেন অভিনেতা…
অভিনয়ের এলেন কিভাবে ?
আমি মূলত সাঙ্গীতিক পরিবারের ছেলে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে এসেছি আমার বাবা বড় জেঠু এবং কাকু নিজেদের পেশার পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চা করছেন বা অভিনয় নিয়ে আলোচনা করছেন। আমার বাবার কাছে শোনা উওম কুমার অভিনীত ” সাড়ে চুয়াওর ” এর পরিচালক নির্মল দে আমাদের নিকট আত্মীয় ছিলেন। আমার বাবারা তিন ভাই দুই বোন এই পাঁচ জনই অসম্ভব ভালো শিল্পী ছিলেন। আমার দুই পিসি ই ভীষণ ভালো গান গাইতেন। আমি বড় হওয়ার পর দেখেছি আমার দিদি কে বিভিন্ন প্রফেশনাল প্রোগ্রামে গান গাইতে।
আমি ও খুব ছোট থেকে তবলা শিখেছি গুরু অলোক দও ও পরে পন্ডিত মোল্লার ঘোষের কাছে। এই তালাবাদ্য শেখার পাশাপাশি নিজের অজান্তেই আমি ভীষণ ভালো নকল করতে পারতাম এর জন্য মা এর কাছে মার পর্যন্ত খেয়েছি। আমার প্রথম অভিনয় ক্লাস থ্রি তে তখন আমার ৬ বছর বয়স ( মায়ের কাছে শোনা, আমার স্মৃতি তে খুব কম মনে পড়ে ) আমাদের স্কুলে পয়লা বৈশাখে সকালে অনুষ্ঠান হতো সেখানেই বাঘ সেজে প্রথম মঞ্চে উঠি। সেই অভিনয়ের হাতেখড়ি। তারপর ক্লাস সেভেন , নাটক ” লক্ষণের শক্তিশেল ” বেলঘড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিখ্যাত নাট্যকার রতন কুমার দাস প্রায় ১০০ জন ছাত্রর মধ্যে আমাকে বেছে নিলেন লক্ষণ চরিত্রের জন্য। স্যারের নির্দেশনায় সেই প্রথম আমি বড় মঞ্চে পা রাখি।
তারপর স্কুলের নাটকের পাশাপাশি বিভিন্ন নাট্য পরিচালকদের কর্মশালায় অংশ নিতে থাকি। তারমধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় , কৌশিক সেন , এবং সোহাগ সেন , গৌতম হালদার প্রমুখ। তারপর প্রফেশনাল থিয়েটারে আমার হাতেখড়ি অঙ্গন বেলঘড়িয়ার কর্ণধার গুরু অভি সেনগুপ্ত র কাছে , সেটা সম্ভবত 2008 সাল । আমি মুলত মফস্বল থিয়েটার টা করেছি । যেখানে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মাসে ৩০ দিনে ৩৫ টা শো করতাম। সেই থিয়েটার ই আমাকে সেট , লাইট , মেকাপ, মিউজিক সব টা শিখিয়েছে। আর আজ আমার যতটুকু অভিনয় মানুষের ভালো লাগে তাঁর সিংহ ভাগ কৃতিত্ব আমি আমার গুরু অভি সেনগুপ্ত র পায়ে অর্পন করলাম। তাঁর সাথে দিনের পর দিন বছরের পর বছর লেগে থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করেছি। তিনি আমাকে ভরসা করে বিভিন্ন প্রযোজনা তে সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করতেন , কম্পোজিশন করবার সাহস দিতেন। খুব ভয় লাগত , ভুল ও করতাম , বকা , মার সবটাই খেয়েছি। আবার আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন কখনো গুরু সুলভ আচরণ করতে দেখিনি প্রতি মুহূর্তে জীবন থেকে অভিনয় শেখাতেন , কি ভাবে আমি থেকে চরিত্র হয়ে উঠতে হয় ওনার থেকে আমার শেখা। এরপর অভি সেনগুপ্ত র পরিচালনায় বহু বহু নাটকে সার্থকতা সাথে অভিনয় করি। বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মুদ্রারাক্ষস নাটকের অভিনয়ের সুযোগ হয় এবং ঔ নাটকে বিপ্লব দা কে সহকারী হিসেবে সাহায্য করেছিলাম এবং কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় চন্দ্রগুপ্ত নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন ম্যাজিশিয়ান অফ বেঙ্গলী থিয়েটার কৌশিক চট্টোপাধ্যায়।
প্রথম কাজ? চরিত্রের নাম?
ইন্ডাস্ট্রিতে আমার প্রথম কাজ উৎসবের রাএ ( ই টিভি বাংলার মেগা সিরিয়াল ) পরিচালক প্রযোজক যীশু দাশগুপ্ত র কাছে অডিশন দিয়েছিলাম তারপর উনি আমাকে ডাকেন। চরিত্রের নাম এই মুহূর্তে মনে নেই। তারপর ই টিভি তে “সাধক বামাক্ষাপা” ধারাবাহিকে টানা আড়াই বছর কাজ করি নাটরের ছোটো কুমারের চরিত্রে।
ফিরকির জার্নি টা কেমন ছিল ?
এই প্রশ্নের উওর টা একটু বিস্তারিত ভাবে দেওয়া প্রয়োজন। 2020 সালের মার্চ মাস থেকে লকডাউন শুরু হয় , লকডাউনের আগে নিয়মিত ভাবে ধারাবাহিক এবং থিয়েটার করে যাচ্ছিলাম কিন্ত লকডাউন হতেই সামগ্রিক চিত্রটা আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে এরই মধ্যে জুন মাসে আমার বাবা মারা যান । আর্থিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক সব দিক থেকে ভেঙ্গে পড়ি। এমনকি পেটে টান পড়তে শুরু করছে এমতাবস্থায় একদিন সাহস করে সানি দা কে ফোন করে ( অ্যাক্রপলিস এন্টারটেনমেন্টের কর্ণধার ) বিস্তারিত জানাই, তারপরের সাত দিনের মধ্যে আমার কাছে হইচই এর “বন্য প্রেমের গল্প ” সিজন টু এর একটা নেগেটিভ চরিত্রের জন্য অফার আসে অ্যাক্রপলিসের পক্ষ থেকে চরিত্রের নাম “জাহাঙ্গীর ” ভীষণ ভাবে উচ্চ প্রশংসিত হয় চরিত্রটি এবং একই দিনে অ্যাক্রপলিসের ধারাবাহিক বিভাগ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হয় ফিরকি ধারাবাহিকের “পুরকায়স্থ” চরিত্রের জন্য। এই চরিত্রটিও দর্শকদের ভীষণ ভালো লাগে। বিভিন্ন সোশাল মিডিয়াতে ট্রোল হতো চরিত্রটি নিয়ে। অ্যাক্রপলিসের কর্ণধার সানি ঘোষ রায় এবং স্নিগ্ধা বাসু যে ভাবে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বিশ্বাস করে চরিত্রটি তৈরি করার স্বাধীনতা দিয়েছে তার জন্য আমি আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকব ওঁদের কাছে।
ধারাবাহিক বাদে অন্য কোনও প্রজেক্ট ?
দেখুন আমি ভীষণ স্পষ্ট কথা বলি। শো অফ করা একদমই পছন্দ করি না। সেই জায়গা থেকে শুধু ইন্টারভিউ এর জন্য বলব না যে হ্যাঁ অনেক গুলো প্রজেক্ট আসছে । কারন আগেই বললাম শো অফ না পছন্দ। অক্টোবরে হইচই’তে একেন বাবু রিলিজ করেছে , সেখানেও একটা ইম্পর্টেন্ট নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেছি। চরিত্রের নাম “লালা” আমি জানি না কেন আমার কাছে এই মুহূর্তে ওয়েব সিরিজের কোনো প্রজেক্ট নেই অথচ দুটো সিরিজের দুটো চরিত্রই ভীষণ ভাবে প্রশংসা পেয়েছে। তবে আমি “না” শোনার অভ্যাস করেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে এসেছি। তাই কোনো প্রজেক্ট ক্যানসেল হলে অবাক হই না। বরং পেয়ে গেলেই অবাক হই।
এই মুহূর্তে “মন ফাগুনে” কোন চরিত্রে অভিনয় করছেন? ধারাবাহিকে চরিত্র টা ঠিক কেমন?
এখানেও সেই নেগেটিভ চরিত্র ….. চরিত্রের নাম “ঘোতন” এটা একটা পাহাড়ী ছেলের চরিত্র যে টাকার জন্য সব করতে পারে। মাথায় যে সাংঘাতিক বুদ্ধি আছে তেমন নয়। ভুল কাজ করে ফেলে মাঝে মাঝে। বসের কাছে বকা মার সব ই খায়। এটাও দিদি ( স্নিগ্ধা বাসু ) ভরসা করে আমাকে দিয়েছেন। ধারাবাহিক সবে তিন চার মাস হলো শুরু হয়েছে এর মধ্যে আমার কাজ দর্শকের ভালো লাগছে এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, যতক্ষণ তুমি টেলিভিশনের পর্দায় আছো দর্শক তোমাকে ততক্ষণ দেখবে আর না দেখতে পেলে যাস্ট ভুলে যাবে। তাই ভালো অভিনয় করে দর্শকের মনে টিকে থাকাটাই আমার প্রধান লক্ষ্য। আর এখনতো পে চ্যানেল হয়ে গেছে সুতরাং ভালো কনটেন্ট এবং ভালো অভিনয় ছাড়া দর্শক দেখবে কেন ? রিমোট তো দর্শকের হাতে। যে কোনও ভাবেই হোক সবদিক থেকে চ্যালেঞ্জ বেড়েই চলেছে।
ভবিষ্যতে পজিটিভ চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছা?
অবশ্যই আছে। তবে আমি সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে চাই। কিন্ত আমাদের ইন্ডাস্ট্রির একটা সমস্যা আছে , যে অভিনেতা যে ভাবে ফিট করে যায় তাকে পরপর সেই ধরনের চরিত্রে কাস্ট করা হয় । এর কারন আমার জানা নেই। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এমন চরিত্র করতে চাই যেটা করতে গিয়ে আমাকে ভয়ানক হোমওয়ার্ক করতে হবে , যে চরিত্র আমাকে এক মুহূর্ত ঘুমোতে দেবে না প্রতি মুহূর্তে আমার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে তবে তো সেই চরিত্র করে মজা।
আশাকরি, আগামীদিনে আরও ভালো ভালো কাজ উপহার দেবেন দর্শকদের। আমাদের পেজের তরফ থেকে অভিনেতা দেবজিৎ সরকারের জন্য জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা এবং ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা রইল।
খুব ভালো লাগল দেবু তোর এই অকপট কথা। অভিনয়ের কাজ করার সময়ে তুই খুব সিরিয়স, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। তাই তুই একদিন চূড়ান্ত সফল হবিই হবি।
এর বাইরে, তুই একজন ভালো মানুষ। সেটাই তোর এই পথে সবথেকে বেশি সাফল্য এনে দেবে।
ভালো থাক। ভালোবাসা আর স্নেহ রইল তোর জন্যে।