দেবাদিদেব মহাদেবের পাঁচটি প্রধান তীর্থস্থানের একটি হল অমরনাথ। শাস্ত্র অনুযায়ী ভগবান শিব এই গুহাতেই মাতা পার্বতিকে অমরত্ম লাভের জ্ঞান দিয়েছিলেন, যাকে অমরকথা বলে সেই থেকেই এই পবিত্র গুহার নাম হয়েছে অমরনাথ গুহা। আজকের আর্টিকেলে রইল অমরনাথ মন্দির যাত্রা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য।
কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় অবস্থিত এই পবিত্র অমর নাথ গুহা, সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১৩০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। প্রতি বছর এই গুহার ওপর থেকে জলকনা নিচে জমে জমে এই ১০ ফিট উচ্চতার শিব লিঙ্গ তৈরি হয়। যদিও এই শিব লিঙ্গের আয়ু এক থেকে দেড় মাসই থাকে। এই গুহায় স্বয়ং ভগবান ভোলেনাথ বাস করেন। এখানে মাতা সতীর গলার অংশ পড়েছিল। তাই এটিকে ৫১ টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি হিসাবে গণ্য করা হয়।
অমরনাথ মন্দিরে কিভাবে যাবেন?
অমরনাথ গুহা, যাকে তীর্থযাত্রীদের তীর্থস্থান বলা হয়। পাশাপাশি অমরনাথ যাত্রা কিন্তু আমাদের দেশের কঠিনতম তীর্থযাত্রা গুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই আপনিও যদি মহাদেবের ভক্ত হতে থাকেন তাহলে বেরিয়ে পড়ুন অমরনাথ যাত্রার উদ্দেশ্যে। অমরনাথ আপনারা অনেক ভাবেই ভাবেই আসতে পারেন। আপনি যদি কলকাতাবাসী হন তাহলে-
বিমানপথে- অমরনাথের নিকটতম বিমানবন্দর হল শ্রীনগর। কলকাতাসহ দেশের যেকোনও প্রান্ত থেকে সহজেই আপনি এখানে পৌঁছতে পারবেন বিমানের মাধ্যমে। এরপর পহলগাম বা বালতাল বেস ক্যাম্পে পৌঁছাতে হবে যা অমরনাথ যাত্রার সুচনাস্থল বলা যেতে পারে।
ট্রেনপথে- অমরনাথ যাত্রার জন্য নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন হল জম্মু তাউই রেলওয়ে স্টেশন, অমরনাথ থেকে ১৭৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জম্মু তাউই থেকে একটি স্থানীয় ট্যাক্সি নিন, অমরনাথ ট্র্যাকের সূচনা পয়েন্ট বালতাল পৌঁছানোর জন্য। এই ট্রেকটি প্রায় ১৫ কিমি পর্যন্ত হয়, যা সম্পূর্ণ হতে ১ থেকে ২ দিন সময় লাগে।
সড়কপথে- সড়কপথে সবার প্রথমে জম্মু, তারপর শ্রীনগর এবং অবশেষে বালতাল বা পাহলগাম ভ্রমণ করুন। পাহলগাম থেকে অমরনাথ ট্র্যাক ৩৬-৪৮ কিমি দূরত্ব কভার করে, যা সম্পূর্ণ হতে ৩-৫ দিন সময় লাগে। অমরনাথ গুহায় যাওয়ার আরেকটি উপায় হল বালতাল হয়ে। পথটি ছোট হলেও খুবই চ্যালেঞ্জিং কারণ এই রাস্তা ভীষণ খাড়াই এবং ভীষণ উঁচু-নীচু। বালতাল থেকে মন্দিরের রাস্তা মাত্র ১৪ কিলোমিটার।
কলকাতা ছাড়াও বাকি অন্যান্য শহর থেকেও খুব সহজে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন অমরনাথ মন্দিরে।
অমরনাথে থাকার সেরা জায়গা । হোটেল
প্রতি বছরই দেশের একাধিক ভ্রমণ পিপাসু বাঙ্গালী স্বর্গরাজ্য কাশ্মীরে ছুটে যায় এই শহরের অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে। সেইসাথে বাবা বারফানি দর্শন তো রয়েছেই। তাই কাশ্মীরসহ অমরনাথ যাত্রায় পর্যটকদের থাকার জন্য বেস্ট হোটেলের সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন, (১০০০- ১৫০০ টাকার মধ্যে) কিছু হোটেল, রিসোর্ট, হাউজ বোট। এর মধ্যে হোটেল জাম্রুদ, হোটেল জাহাঙ্গীর, গ্র্যান্ড হোটেল উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও অমরনাথ যাত্রায় পেহেলগামে লিডার নদীর ধারেও বেশ কিছু রিসোর্ট রয়েছে যা পর্যটকদের জন্য থাকার উপযুক্ত।
অমরনাথ যাওয়ার সেরা সময়
বাবা বারফানির দর্শন পেতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত অপেক্ষায় থাকেন। অমরনাথে শিবলিঙ্গের দর্শন মানে সাক্ষাৎ মহাদেবের দর্শন করা হয় বলে ধারণা সকলের। তবে অমরনাথ যাত্রার সময় খুব সংক্ষিপ্ত, মোটামোটি ৪৫-৫৪ দিনের মধ্যেই এই যাত্রা শেষ হয়ে যায়। জুন থেকে আগস্ট মাসকে অমরনাথ যাত্রার সেরা সময় বলে মনে করা হয়।
ইংরেজির জুন মাসের শেষ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দরজা। এরপর থেকেই পবিত্র গুহার মধ্যে তৈরি হওয়ার শিবলিঙ্গ একটু করে গলে যেতে থাকে। সাধারণত স্কন্ধ ষষ্ঠী দিন থেকে এই যাত্রা শুরু হয় এবং রাখীপূর্ণিমার দিনে এসে শেষ হয়। অমরনাথ যাত্রায় দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল পথ হলেও মহাদেবের টানে বয়স নির্বিশেষে ভক্তদের সমাগম হয় এই পুণ্যস্থানে।
অমরনাথ মন্দিরে পূজার সময়
অমরনাথের পবিত্র গুহা কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ১৪১ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রতল থেকে ১২,৭৫৬ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সমুদ্রতল থেকে এত উপরে অবস্থিত হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময়টা হিমবাহ ও বরফে ঢাকা থাকে।
শ্রাবণী পূর্ণিমায় পূর্ণবয়ব হন অমরনাথ। অমরনাথের গুহার ছাদ থেকে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে, আর সেই জল জমে শিবলিঙ্গের আকার ধারণ করে, তখন শিবলিঙ্গের উচ্চতা হয় ৮ ফুট পর্যন্ত। জুন জুলাই মাসে শুরু হয় অমরনাথ যাত্রা, আর শেষ হয় জুলাই অগস্ট মাসে। বছরে এই সময়টাতেই মন্দিরে পূজার জন্য লক্ষ লক্ষ ভক্ত সেখানে যাত্রা করেন একমাত্র মহাদেবের কাছে পূজা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
অমরনাথ মন্দিরের আশেপাশে ঘোরার জায়গা
ভ্রমণ প্রেমীদের মানুষদের কাছে জম্মু-কাশ্মীর সবসময়ের পছন্দের ডেস্টিনেশন। সেইসাথে অমরনাথ যাত্রা ছাড়াও মন্দিরের আশেপাশে রয়েছে আরও অনেক স্পট। পহেলগাঁওর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে এমন অনেক জায়গা যা প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি। জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পর্যটনের ভরা মরশুমে পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে। তবে চিরাচরিত ট্যুরিস্ট স্পট ছাড়াও রয়েছে বেতাব ভ্যালি, লিডার নদী, আরু ভ্যালি, লোলাব ভ্যালি, গুরেজ, তুলেইল ভ্যালি, পহেলগাঁও, শেষনাগ লেক ইত্যাদি।
অমরনাথ যাত্রায় সেরা খাবার
শুধু অমরনাথ যাত্রাই নয়, সমগ্র জম্মু-কাশ্মীরের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি এখানকার খাবারেও রয়েছে বৈচিত্র্য। আর কাশ্মীর ভ্রমনে এই সমস্ত সুস্বাদু খাবার অন্তত একবার চেখে না দেখলে খাদ্যরসিক পর্যটকের জীবন বৃথা। কাশ্মীরের জনপ্রিয় স্ন্যাক্স নাদুর চুরমা, শীর চা, তেহরি, পুষ্টিকর হাখ, রোগান জোশ, ইয়াখনি, সবশেষে মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলোর মধ্যে মোদুর পোলুভ, সুফতা অন্যতম জনপ্রিয়। ব্রেকফাস্ট টু ডিনার, স্ন্যাক্স টু মেইন কোর্স এই শহরে সবই পাবেন ভিন্ন রকম স্বাদে।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন ও উত্তরঃ
প্রঃ অমরনাথ কোথায় অবস্থিত?
উঃ জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত এটি একটি শৈব তীর্থক্ষেত্র। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ১৪১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই তীর্থে যেতে পহেলগাও শহর অতিক্রম করতে হয়।
প্রঃ অমরনাথ যাত্রার তাৎপর্য কি?
উঃ শিব ভক্ত মানুষের অনেকেরই স্বপ্ন থাকে অমরনাথ যাত্রা করার এবং এক বারের জন্য হলেও বাবা বর্ফানির দর্শন করার, কারন এই যাত্রার আলাদাই একটা মহাত্মা আছে। পুরাণ কথা অনুযায়ী, দেবাদিদেব মহাদেব নাকি এই গুহায় মাতা পার্বতিকে অমরত্ম লাভের জ্ঞান দিয়েছিলেন। সেই থেকেই এই পবিত্র গুহার নাম হয়েছে অমরনাথ গুহা। এটিকে ৫১ টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি হিসাবেও গণ্য করা হয়।
প্রঃ অমরনাথ যাত্রার প্রধান রুট দুটি কি কি?
উঃ ১. পাহলগাম রুট- এখান থেকে অমরনাথ প্রায় ৪৬ কিমি দুরত্বে।
২. বালতাল রুট- এই রুট অনুযায়ী মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিমি।
প্রঃ অমরনাথ পৌঁছানোর জন্য কি কি বিধিনিষেধ মানা বিশেষ জরুরী?
উঃ অমরনাথ যাত্রায় তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কিছু বিধিনিষেধ এবং নির্দেশিকা রয়েছে। যেমন- প্রয়োজনীয় পারমিট এবং রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত করা, নির্দিষ্ট রুট অনুসরণ করা এবং অমরনাথ শ্রাইন বোর্ড এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্দেশাবলী অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রঃ অমরনাথ যাত্রার রেজিস্ট্রেশনের জন্য কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে?
উঃ অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে ‘শ্রী অমরনাথজী শ্রাইন বোর্ড’-এর নিজস্ব ওয়েবসাইট http://jksasb.nic.in ক্লিক করলেই হবে। সেক্ষেত্রে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে মাথাপিছু খরচ হবে ২২০ টাকা, বিদেশি ভ্রমণার্থীদের জন্য মাথাপিছু ১৫২০ টাকা। যাত্রার সময়ে অবশ্যই নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে।
প্রঃ অমরনাথ যাত্রার সুযোগ কারা পাবেন?
উঃ ১৩ থেকে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত পুরুষ এবং মহিলারা এই যাত্রায় অংশ নিতে পারেন, তবে অন্তঃসত্ত্বা কোনও মহিলাই এই গুহার উদ্দেশে যাত্রা করতে পারবেন না।
প্রঃ অমরনাথ যাত্রায় কি কি সচেতনতা অবলম্বন করা জরুরী?
উঃ প্রায় দেড় হাজার ফিট উপরে পায়ে হেঁটে অমরনাথ যাত্রা করতে শারীরিক এবং মানসিক বল অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে
১. খাড়া চড়াই বেয়ে ওঠার সময় তাড়াহুড়ো করবেন না। ধীরে হাঁটুন। প্রয়োজনে বিশ্রাম নিন। ২. ডিহাইড্রেশনের সমস্যা দূর করতে অন্ততপক্ষে ৪-৫ লিটার জল পান করুন।
৩. শীতের পোশাক রাখুন। তাপমাত্রা যে কোনও মুহূর্তে নীচে নেমে যেতে পারে।
৪. উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা, বমি ভাব, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধির মতো উপসর্গ থাকলে নিয়মিত যে ওষুধগুলি খেতে হয় তা সঙ্গে নিন। ভ্রমণের আগে মেডিক্যাল-চেক আপ করান।
৫. নিজের পরিচয়পত্র এবং যাত্রার পারমিট অবশ্যই সাথে রাখতে হবে। বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য শংসাপত্র বা Compulsory Health Certificate সঙ্গে রাখতেই হবে।
প্রঃ কাশ্মীরের পাহলগামের কোন অংশকে মিনি সুইজারল্যান্ড বলা হয়?
উঃ পাহলগামের বিখ্যাত স্পট বাইসারন মিনি সুইজারল্যান্ড নামে পরিচিত।
প্রঃ জম্মু ও কাশ্মীর ভ্রমণের সেরা সময় কোনটি?
উঃ এপ্রিল থেকে অক্টোবর। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে। মূলত গ্রীষ্মকালই এই রাজ্যের সেরা পর্যটন ঋতু।